কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ কৃষিপণ্য প্রতিযোগিতায় যে টিকতে পারছে না, তার বড় কারণ নিরাপদ খাদ্যমান বজায় রাখতে না পারার ব্যর্থতা। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা উত্তম কৃষিচর্চা নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে জৈব সার ও বায়োপেস্টিসাইড ব্যবহারের দিকে জোর দিলেও বাস্তব প্রয়োগে এখনো বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইত্তেফাকের রায়গঞ্জ (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা দীপক কুমার কর জানান, সম্প্রতি এই উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের কোদলাদিগর গ্রামের একটি বড় খেতের টম্যাটোগাছগুলোর পাতা কুঁকড়ে নুয়ে পড়তে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে এই খেতের কৃষক আশরাফুল আলম জানান, ভুল ও অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে তার খেতের ৭০ শতাংশ টম্যাটোগাছ নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু রায়গঞ্জের কৃষকই নন, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে সারা দেশের কৃষকই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকার ইতিমধ্যেই ৪০টি কীটনাশক নিষিদ্ধ করেছে। তবে এটা যথেষ্ট নয় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. আবুল হাসনাত বলেন, অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মানবদেহের ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহারের ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপাদন হয়, যা পরিবেশের ক্ষতি করে। আবার অ্যামোনিয়া বেশি ব্যবহারের ফলে পানির মধ্যে অক্সিজেন কমে যায়। এতে পানিতে মাছ থাকতে পারে না। তিনি বলেন, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে মানবদেহে মারাত্মক সব রোগ হতে পারে। ক্যানসার, কিডনি বিকল ও ফুসফুসের নানা ধরনের জটিল রোগ হতে পারে। এছাড়া, নারীদের প্রজনন–সমস্যাও দেখা দিতে পারে। বাড়ছে কীটনাশকের ব্যবহার :দেশে কীটনাশকের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। ২০২৩ সালে কীটনাশকের ব্যবহার প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছেছে, যা ১৯৭২ সালে ছিল মাত্র ৪ হাজার টন। অর্থাৎ ১৯৭২ সালের তুলনায় এটি ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কীটনাশক মূলত ধান, শাকসবজি ও ফল চাষে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে কীটনাশকের বাজার ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা এ খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার একটি বড় প্রমাণ। আবাদযোগ্য জমির প্রায় ৬১ শতাংশে জৈব পদার্থের ঘাটতি :মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) সূত্র তাদের সবশেষ একটি গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে জানায়, মাটিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে দেশের মোট আবাদযোগ্য ১ কোটি ৬০ লাখ হেক্টর জমির প্রায় ৬১ শতাংশে জৈব পদার্থের বিপুল ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
জমির উর্বরা শক্তি কমার মূল কারণ হচ্ছে, একই জমিতে বছরে একাধিক বার ফসল চাষ এবং মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার। সাধারণত ৪৫ শতাংশ খনিজ বা মাটির কণা, ৫ শতাংশ জৈব এবং ২৫ শতাংশ করে পানি ও বাতাস থাকা মাটিকে সুষম মাটি বলা হয়। একটি আদর্শ জমিতে জৈব পদার্থের মাত্রা ৩ দশমিক ৫ শতাংশ থাকা অতি প্রয়োজনীয় হলেও এ দেশের বেশির ভাগ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং কিছু কিছু জমিতে এর পরিমাণ ১ শতাংশের চেয়েও কম। দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ জমিতে দস্তার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। অপরিকল্পিত চাষাবাদ, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার, ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দূষণ, ব্যাপক হারে বনভূমি ধ্বংস এবং অপরিকল্পিতভাবে সারের ব্যবহারের কারণে মাটি উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার, একই জমিতে যুগের পর যুগ একই ফসলের চাষ, জমিকে বিশ্রাম না দেওয়া, ইটভাটার জন্য মাটির উপরিভাগের অংশ তুলে নেওয়া ছাড়াও মাটির টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির ফলে মৃত্তিকা এখন হুমকির মুখে রয়েছে। আর মাটির স্বাস্থ্যহীনতায় প্রতি বছর ফসল উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। গত এক দশকে বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির মাটির উর্বরতার মাত্রা শতকরা ২ দশমিক ৫ থেকে শতকরা ১ দশমিক ৫–এ দাঁড়িয়েছে বলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
কীটনাশকজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন দেশের ২৭ শতাংশ কৃষক: আন্তর্জাতিক সংস্থা সেন্টার অব এগ্রিকালচার অ্যান্ড বায়োসাইন্স ইন্টারন্যাশনাল (কাবি) সম্প্রতি রাজধানীতে কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে এক সেমিনারে তাদের গবেষণালব্ধ তথ্য তুলে ধরে জানায়, দেশের প্রায় ২৭ শতাংশ কৃষক কীটনাশকজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন। যেমন চোখ জ্বালা, ত্বকে ফোসকা, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা থেকে শুরু করে দীর্ঘ মেয়াদে ক্যানসার, জন্মগত ত্রুটি, প্রজননজনিত সমস্যা ও স্নায়বিক জটিলতা। সংস্থাটির প্রোজেক্ট কোঅর্ডিনেটর ড. দিলরুবা শারমিন উপস্থাপিত এই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে—দেশে বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার বাণিজ্যিক কীটনাশক নিবন্ধিত, যার মধ্যে ৩৬৩ ধরনের সক্রিয় উপাদান ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো মূলত ধান, শাকসবজি ও ফলচাষে ব্যবহৃত হচ্ছে। অধিকাংশ কৃষক কীটনাশকের মাত্রা, মিশ্রণ বা ব্যবহারবিধি মানেন না। অনেক সময় লেবেলের নির্দেশনাও উপেক্ষা করেন। ফলস্বরূপ খাদ্যপণ্যে বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ থেকে যায়, যা ভোক্তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কীটনাশক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে প্রায় ২ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ মো. আসাদুল্লাহ বলেন, ‘খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে কৃষক মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে খাদ্যে বিষ ঢুকছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের প্রথমত কৃষকদের কীটনাশক নামক বিষের ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। কৃষকদের সময়মতো সঠিক পরামর্শ দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সমস্যা হলো, কৃষকরা অনেক সময় যেখান থেকে কীটনাশক, সার কেনেন, সেই বিক্রেতাদের কথামতো তা ব্যবহার করেন। এতে বেশি ক্ষতি হচ্ছে।