কীটনাশক দেশে উৎপাদন না করে আমদানিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিলো। একটি অসাধু সিন্ডিকেট নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, অবৈধ সোর্স থেকে কীটনাশক আমদানি করে প্রান্তিক ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করছে। এতে করে, একদিকে যেমন সরকার একটি বড় রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অপরদিকে এই নিম্নমানের বালাইনাশক ব্যবহার করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক। এ ধরনের দেশবিরোধী কাজের সাথে সরকারের কিছু অসাধু আমলা ও ট্রেডিং সিন্ডিকেট জড়িত। দেশে কৃষি খাতে চাহিদার শতকরা ৯০ ভাগ বালাইনাশক আমদানিনির্ভর। বাকি ১০ ভাগের কাঁচামাল আমদানি করে বাংলাদেশে উৎপাদন করা হলেও একটি শর্তের কারণে সংকটে রয়েছে কৃষিভিত্তিক দেশীয় এ শিল্প। জানা গেছে, আমদানি করা এসব কীটনাশকের মান নিয়ন্ত্রণ করার কোন ব্যবস্থা নেই ট্রেডার্সদের।
তাই কৃষকেরা সবসময় প্রতারণার শিকার হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছে, যদি স্থানীয় ভাবে কীটনাশক উৎপাদন করা যায় তাহলে মান নিয়ন্ত্রণ হয় এবং দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। সম্প্রতিকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আন্তঃ সভায় বাণিজ্য উপদেষ্টা ও সচিব স্থানীয়ভাবে বালাইনাশক উৎপাদনের লক্ষ্যে উৎপাদনকারীদের সার্বিক সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশনা দেন। বাংলাদেশ সরকার কীটনাশকের আমদানি নির্ভরতা কমাতে এবং কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় কমাতে স্থানীয়ভাবে বালাইনাশক উৎপাদনে গুরুত্বারোপ করেছে। সরকার দেশের স্বার্থে নীতি সংস্কার করে বালাইনাশক স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বালাইনাশক বাজারজাত করার সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন কর্তৃপক্ষ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে কৃষি খাতে বালাইনাশকের বাজার প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে অধিকাংশই আমদানি করে চাহিদা পূরণ করতে হয়। এ কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে।
তবে যেসব দেশীয় কোম্পানি বালাইনাশকের আমদানি নির্ভরতা কমাতে কাজ করছে, তাদের শর্ত দিয়ে আটকে ফেলা হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বছরের পর বছর ধরে সুবিধা দিতে আমদানি উৎসাহিত করছে একটি প্রভাবশালী চক্র। সূত্র বলছে, স্থানীয় উৎপাদিত বালাইনাশক যেন বাজারজাত না করতে পারে সেজন্য অসাধু ট্রেডিং সিন্ডিকেট বিভিন্ন উপায়ে উৎপাদনকারী সৎ ও পরিচ্ছন্ন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেছে এবং তারা মন্ত্রণালয়ের প্রণীত শিল্প নীতির বিরোধিতা করছে। আরো জানা গেছে, দেশীয় উৎপাদকরা নানা শুল্ক বাধার কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। অন্য দিকে, তুলনামূলক সুবিধা নিয়ে ট্রেডিং সিন্ডিকেট দিন দিন আরো লাভবান হচ্ছে। খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে বর্তমানে একাধিক প্রতিষ্ঠান কীটনাশক উৎপাদন বা ফরমুলেশন কারখানা স্থাপন করেছে। কিন্তু কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্ক ও জটিল প্রক্রিয়ার কারণে তাদের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় স্থানীয় পণ্য বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। তারা বলছেন, দেশীয় উদ্যোক্তারা কাঁচামালে ২৫–৩০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিয়ে থাকে।
অথচ আমদানিকৃত তৈরি পণ্য মাত্র ১০–১৫ শতাংশ শুল্কে আসে, তা হলে দেশীয় উৎপাদক কিভাবে টিকবে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের শিল্প উন্নয়নের সুযোগই থাকবে না বলে উদ্যোক্তারা জানান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বলছেন, নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ে দেখা যায় আমদানি করা অধিকাংশ কীটনাশকই ভেজাল। এসকল ভেজাল বা নকল কীটনাশক বাজারে প্রবেশ করে, যা সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় বিক্রি হয়। এসব নিম্নমানের কীটনাশক ব্যবহার করলে ফসলের ক্ষতি তো হয়ই, মাটির উর্বরতাও নষ্ট হয়। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়ে জনস্বাস্থ্যে, কারণ এসব বিষাক্ত রাসায়নিক খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে। আমরা এব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছি। এগ্রো কেমিক্যাল ব্যবসায়ী ও এফবিসিসিআইয়ের কেমিক্যাল স্ট্যান্ডিং কমিটির কো চেয়ারম্যান কামাল হোসেন পলাশ বলেন, কীটনাশক উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানিতে সর্বোচ্চ ৮০% পর্যন্ত সরকারকে শুল্ক দিতে হয় উদ্যোক্তাদের। আর কীটনাশক আমদানিতে মাত্র ৫% শুল্ক পরিশোধ করতে হয় আমদানিকারকদের। এধরনের বৈষম্য কোনভাবেই কাম্য নয়। সরকারকে মনে রাখতে হবে কৃষককে বাঁচাতে হলে, দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করতে হলে অবশ্যই উৎপাদনকারীদের সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে।