ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের প্রতিনিধিরা যুদ্ধ বন্ধ এবং বন্দি হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। গতকাল আবারও আলোচনায় বসে দুপক্ষ। যুদ্ধের অবসানে পক্ষগুলো একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে আলজাজিরা। তবে এর মধ্যেও দখলদার দেশটির হামলায় আটজন নিহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর দুই বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার। মিসরের রাজধানী কায়রোয় শান্তি আলোচনা চলার মধ্যেও নির্বিচার হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিদের সীমাহীন দুঃখ–দুর্দশা যখন তৃতীয় বছরে পদার্পণ করছে, তখন শান্তি আলোচনা কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে। সোমবার প্রথম দিন চার ঘণ্টার আলোচনা ইতিবাচকভাবে এগিয়েছে। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল–আনসারির মতে, বন্দি হস্তান্তর ও গাজায় ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর ব্যাপারে একমত হয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা। তিনি বলেন, আগেই ইসরায়েলের হামলা বন্ধ করা উচিত ছিল।
তা না করে তারা ট্রাম্পের প্রস্তাব ভঙ্গ করছেন। গাজার ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনিদের হাতেই থাকা উচিত এবং কোনো বহিরাগত পক্ষ এই ভূখণ্ডের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারবে না। ফিলিস্তিনি ও মিসরীয় কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, আটক শত শত গাজার নাগরিকের বিনিময়ে ৪৮ জন ইসরায়েলি জিম্মির মুক্তির পথ খুলে যেতে পারে আলোচনায়। তাদের মধ্যে ২০ জন জীবিত বলে মনে করা হচ্ছে। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে প্রথম দিনের আলোচনার পর ট্রাম্প ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের বলেন, শান্তি চুক্তিতে একমত হতে সত্যিই ভালো সুযোগ রয়েছে। এটি একটি স্থায়ী চুক্তি হবে। আমরা শান্তি চাই। হামাস আলোচনার সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় সম্মত হয়েছে। ৭ অক্টোবরের হামলার দুই বছর পূর্তিতে হামাস বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দুই বছর ধরে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা, নিপীড়ন ও দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদাসীনতা ছিল লজ্জাজনক।
ফিলিস্তিনি সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, মঙ্গলবার ভোর থেকে গাজাজুড়ে ইসরায়েলি বন্দুকযুদ্ধ ও গোলাগুলিতে একজন ত্রাণকর্মীসহ সাতজন নিহত হয়েছেন। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস ও উত্তরে গাজা শহরের বাসিন্দারা গতকাল ভোরে ট্যাঙ্ক এবং বিমান থেকে ভারী বোমা বর্ষণ করে। গত ৩ অক্টোবর ট্রাম্প ইসরায়েলকে বোমা হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেদিন থেকে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ১০৪ জন নিহত হয়েছেন। গত ২৪ মাসে ৬৭ হাজার ১৬০ জন নিহত এবং ১ লাখ ৬৯ হাজার ৬৭৯ জন আহত হয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, আরও হাজার হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন।
আলোচনায় যেসব দাবি তুলল হামাস
মিসরে চলমান যুদ্ধবিরতি আলোচনায় হামাস তাদের প্রধান শর্তগুলো বিস্তারিত তুলে ধরেছে। হামাসের মুখপাত্র ফাওজি বারহুম বলেছেন, তাদের প্রতিনিধি দল সব বাধা অতিক্রম করে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে, যা গাজার জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে। দাবিগুলো হলো– একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, মানবিক ও ত্রাণ সহায়তার অবাধ প্রবেশ, বাস্তুচ্যুতদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনা, ফিলিস্তিনি জাতীয় টেকনোক্র্যাট সরকার বাস্তবায়ন এবং ন্যায্য বন্দিবিনিময় চুক্তি।
দুই বছরে গাজার পরিস্থিতি ভয়াবহ
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত গাজায় ৬৭ হাজার ১৭৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ১ লাখ ৬৯ হাজার ৭৮০ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ২০ হাজার ১৭৯ শিশু। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় একটি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও বহু মৃত মানুষ থাকতে পারে। ১ অক্টোবর পর্যন্ত গাজায় তীব্র অপুষ্টিতে ১৫১ শিশু মারা গেছে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিন শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানায়, গাজায় প্রায় ১৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত, যা মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ। গাজায় পাঁচ লাখের বেশি মানুষ বিপর্যয়কর ক্ষুধায় পতিত হয়েছে। আগস্ট মাসে গাজায় তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে এমন শিশুর সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। ইউনিসেফের তথ্যমতে, ৩ লাখ ২০ হাজারের বেশি শিশু তীব্র অপুষ্টির ঝুঁকিতে রয়েছে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউর তথ্যপত্রে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৬৬ হাজার ১০০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের ১৮ হাজার ৪৩০ জনেরও বেশি শিশু। গাজাজুড়ে প্রায় ৮০ শতাংশ কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। অপুষ্টিতে ৪৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন, যাদের এক–তৃতীয়াংশ শিশু।
বুধবার ভোরে আমরা ‘রেড জোনে’ পৌঁছাতে পারি: শহিদুল আলম
ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের অংশ হিসেবে গাজা অভিমুখী কনশেনস জাহাজটি আজ বুধবার ভোর নাগাদ ‘রেড জোন’ তথা বিপজ্জনক অঞ্চলে পৌঁছে যেতে পারে। দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম গতকাল এক ফেসবুক পোস্টে এমন তথ্য জানিয়েছেন। তিনি কনশেনস জাহাজে আছেন। ফেসবুক পোস্টে শহিদুল আলম লিখেছেন, আমরা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে আছি। কারণ ‘থাউজেন্ড ম্যাডলিনস’ নৌবহরে থাকা ছোট ও ধীরগতির নৌযানগুলো যেন পেছনে পড়ে না যায়, তা নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।
ইসরায়েলকে ২১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা যুক্তরাষ্ট্রের
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২ হাজার ১৭০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটিজ ওয়াটসন স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্স জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আনুমানিক ১০ বিলিয়ন বা তার বেশি অর্থ নিরাপত্তা সহায়তার জন্য ব্যয় করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া ইসরায়েল গাজায় তাদের অভিযান পরিচালনা করতে পারত না।
ইসরায়েলে শোক কর্মসূচি
হামাসের হামলার বর্ষ পূর্তিতে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে শোক কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গতকাল এ কর্মসূচিতে হাজারো ইসরায়েলি অংশ নেয়। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা হলোকাস্টের পর থেকে ইহুদি জনগণের ওপর সবচেয়ে খারাপ নজির ছিল।