বৈচিত্রে ভরা মানুষ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে যে কোনো গবেষক তালদিশা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য; কেননা মানুষের মধ্যে পারষ্পরিক মিলনের চাইতে গড়মিল বা বৈষম্য রয়েছে অধিক। মানুষ মানুষকে কতল করে, পণ্য হিসেবে বিক্রি ও ব্যবহার করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করার তাগিদে, মানুষ মানুষের দাসে পরিণত, এক গোষ্টি আর এক গোষ্টিকে বিজাতীয় ভেবে বসে আছে। অথচ মানুষের নির্মাতা তাদের ডেকে বলে আমিই তো তোমাদের সৃষ্টি করেছি আমার প্রতিনিধি হিসেবে, আর নিজের সুরতে সৃষ্টি করেছি যেন উপযুক্তভাবে আমার পক্ষে দূতিয়ালী করতে তোমাদের কোনো সমস্যায় পড়তে না হয় (পয়দায়েশ ১ : ২৬-২৭)।
কালামের আলোকে আমরা দেখতে পেলাম মানুষ হলো খোদার প্রতিমূর্তীতে গড়া তাঁরই বিশেষ প্রতিনিধি। মানুষকে তিনি দোয়া করলেন, ক্ষমতা দিলেন, প্রজ্ঞা-ধার্মিকতা বিবেক-বিবেনা দিয়ে পরিপুষ্ট করে তুললেন যাতে তারা অদৃশ্য রূহানি খোদার ঐশি গুণাবলী প্রকাশ করতে পারে এবং তদানুযায়ী গোটাবিশ্ব করতে পারে পরিচালনা।
কথায় বলে, বোবারও শত্রু আছে। যিনি কেবল সকলের কল্যাণকর্মে রয়েছেন সদাজাগ্রত, কর্মক্ষম ও অনন্তজীবি, সেই মহান খোদারও রয়েছে এক চরম দুষমণ, যে কিনা সদাসর্বদা সুযোগ খুঁজে ফিরছে উত্তম সৃষ্টি বিনাশ করে দেবার জন্য। খোদার যোগ্য প্রতিনিধি প্রথম মানুষ আদমকে, অবশ্য বিবি হাওয়াকে প্রলুবদ্ধ করলো খোদার আদেশ ভেঙ্গে ফেলে নিশিদ্ধ কাজ করার জন্য। বড়ই উচ্চাভিলাষী করে তুললো তাদের, খোদার মত ক্ষমতাধর হবার জন্য। খোদাদ্রোহী কাজ করে বসলো প্রথম জোড়া মানুষ; ফলস্বরুপ হারিয়ে ফেললো ঐশি গুনাবলি ও ক্ষমতা, পরিবর্তে পরিপুষ্ট হলো ইবলিসের সার্বিক কুট কৌশলে। প্রথম কুফল দেখতে পাই ভ্রাতা হনন। কাবিল স্বীয় সহোদর ভ্রাতা হাবিলকে কতল করে ধরিত্রী মানুষের রক্তে রঞ্জিত করে দিল। শুরু হলো মানব নিধনের মারাত্মক মহড়া। বর্তমান বিশ্বে মানুষ খুন করাটা যেন একটা ফ্যাশন হয়ে দাড়িয়েছে। মানুষের মধ্যে খুন করার প্রবণতা তাদের হৃদয়ের মধ্যে ধাতস্থ হয়ে পড়েছে। কোনো সাধুবাদ আর কাজ করছে না প্রতিহত করার নিমিত্তে।
খোদার সুমহান পরিকল্পনা এভাবে বিনাশ পাক তা তিনি কেমন করে মেনে নিবেন? মানুষকে হেদায়েত করার জন্য তিনি তাদের কাছে তাঁর মনোবাসনা প্রকাশ করতে শুরু করলেন। বারবার সাবধান করে চললেন, তাদের ফিরিয়ে নেবার জন্য তারই পথে। মানুষের অবস্থান উপলব্ধি করার জন্য তিনি যে দশ আজ্ঞা প্রদান করলেন তা যদি দশ খানা ফুলসাইজ আয়নার সাথে তুলনা করা হয় তবে মোটেই অতিরঞ্জিত হবার নয়। কেউ যখন আয়নার সামনে দাড়ায় তবে সে নিজের অবয়ব দেখতে পায়, দেখতে পায় স্বীয় মুখশ্রী, যা কেউ কখনো দেখার ক্ষমতা রাখে না। গল্পচ্ছলে বলা চলে, কোনো এক সিম্পাঞ্জী তেমন একটি আয়নার সামনে দাড়িয়ে স্বীয় প্রতিদ্ধন্ধি কিম্ভুত কিমাকার এক মূর্তী দেখামাত্র আয়নার উপর মেরে দিল এক ঘুষি, অমনি ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল উক্ত সিল্পাঞ্জীটি। পাঠকবৃন্দ বলুন, কে কাকে ঘুষি মারলো, আর কার কাছে কে-ই বা কদাকার বলে মনে হলো?
আমরা মানব সমাজ, আজকে আমাদের অবস্থা উক্ত সিম্পাঞ্জীর চাইতে বেশি কিছু বলে মনে হয় না। আমাদের বিবেক চেতনাদৃপ্ত করার জন্য যে দশ আজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা আমরা মুষ্ঠাঘাত দিয়ে শতখন্ড করে ফেলেছি। কেননা আমাদের স্বভাব আচরণের সাথে তা সাযুজ্য মনে হয় না। তদস্থলে নিজেরা নিজেদের মনমত আইন-কানুন রচনা করে পথ চলতে শুরু করেছি, সকল সমস্যার সমাধান খুঁজে ফিরছি উক্ত স্বরচিত নিয়মাচারের মাধ্যমে, অথচ বুঝতে চাই না, আমরা সম্পূর্ণ বিনাশ প্রাপ্ত, আমাদের ধার্মিকতা কেবল ছেড়া মলিন কাপড়ের মত, আমাদের পাপ আমাদের জীর্ণ করে তুলেছে, যেমন শুকনো পাতা বাতাশে উড়িয়ে নিয়ে যায় (ইশাইয়া ৬৪ : ৬) খেয়াল খুশি মত, ঠিক একইভাবে ইবলিস দিয়াবল আমাদের দিয়ে খোদাদ্রোহী কাজ করিয়ে চলছে দিবানিশি। কখনো কখনো বিবেক আমাদের কাছে আপত্তি জানায়, তবে কে তার ডাকে সাড়া দেয়; কেননা, আমরা হলাম ইবলিসের খাঁচাবন্দী। চাই আমাদের অবমুক্ত করার এমন এক মহান পরাক্রমী দয়ার্দ্র ব্যক্তি যিনি আমাদের মত পাপ কালিমা দ্বারা আপ্লুত নন। যিনি হলেন শতভাগ ঐশি নূরে পরিপূর্ণ, ক্ষমতা রাখেন অভিশপ্ত ইবলিসের সার্বিক ক্ষমতার উপর, যার হাতে হয়েছে ইবলিস চরমভাবে পরাভুত।
তিনিই হলেন প্রতিজ্ঞাত নাজাতদাতা, মানুষের পাপের কাফফারা পরিশোধ করলেন স্বীয় পূতপবিত্র রক্তের মূল্যে।
যদিও তিনি বিশ্বের আপামর জনতাকে আত্মবৎ প্রেম করলেন, তথাচ অকৃতজ্ঞ মানুষ তাকে উল্টো তাড়না লাঞ্চনা করে নিষ্ঠুরভাবে সলিবে হত্যা করলো। যদিও তিনি মৃত্যুকালে তাদের ক্ষমা করেছেন এ বলে, পিতা এদের ক্ষমা করো, কেননা তারা জানে না যে কি করছে।
গোটা বিশ্বের পাপভার তিনি স্বীয় কাধে বহন করে প্রায়শ্চিত্ত শোধ দিলেন সলিবে, যেন বিশ্বাসহেতু আজ আমরা পেতে পারি অনন্ত মুক্তি (ইফিষীয় ২ : ৮-১০), হতে পারি স্নাতশুভ্র, ফলে ঘটে আমাদের পিতার সাথে পুনর্মিলন। মসিহ আমাদের কেবল গুনাহের দাসত্ব থেকে অবমুক্তই করেন নি উপরন্তু তিনি আমাদের মধ্যে ফুঁকে দিলেন এক সহায়, যিনি হলেন পাকরূহ, যিনি নিয়ত চেতনা দিয়ে ফিরছেন সত্য সুন্দরের পথে, পরিচালনা করার জন্য, যার ফলে বিশ্বাসীদের মাধ্যমে খোদার মহিমা নিত্যদিন প্রকাশ লাভ করে।
তিনি জানেন আমাদের দৌড়, তাই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আমাদের মধ্যে অভিষিক্ত পাকরূহ নিত্যদিন পথ দেখিয়ে আমাদের পূর্ণাঙ্গ সত্যে পৌছে দেবেন (ইউহোন্না ১৬ : ১৩)।