মৌলভীবাজারের নীতেশ্বরে দুসাই রিসোর্টের আকাশটা সেদিন সকালে ছিল কালো মেঘে ঢাকা। ঝরঝর বাদলের ধারায় সিক্ত ছিল প্রকৃতি। রিসোর্টে মাঠের বদলে ছিল সুনীল জলের বড় সুইমিংপুল। পুলের পাড়ে ফুটেছিল অনেকগুলো কালো বাদুড় ফুল। সুইমিংপুলের জল থেকে ঝোপ ঝোপ গাছের ফাঁকে ওগুলোর দিকে চোখ পড়তেই কালো ফুলগুলো নজর কাড়ে। যেন সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে কোনো কৃষ্ণকলি ডাকছে। তার কালো হরিণ চোখের ইশারা উপেক্ষা করার উপায় ছিল না। জল থেকে উঠে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কাছে গিয়ে সে ফুলগুলো দেখে অবাক হলাম। মুক্তবেণি না থাকলেও কালো রঙের অসংখ্য চুলের মতো কেশর যেন ঝর্ণায় জলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে পাপড়ির মাঝখান থেকে। ফুলের বৃতিগুলোও বিচিত্র, অবিকল বাদুড়ের ডানা। এ কারণেই এ ফুলের ইংরেজি নাম হয়েছে ব্ল্যাক ব্যাট ফ্লাওয়ার। ফুলের জগতে বহু রঙের ফুল থাকলেও কালো ফুলের দেখা সহজে মেলে না।
যে গোলাপকে বলা হয় কালো গোলাপ, সেও আসলে প্রকৃত কালো রঙের নয়। ফুলের এই ব্যতিক্রমী কালো রং এবং ভিন্ন রকমের চেহারা পুষ্পপ্রেমীদের কাছে বাদুড় ফুলকে আলাদা কদর দিয়েছে। বিকেলে ও সন্ধ্যাবেলা গিয়েও সে রিসোর্টের পথঘাট, কটেজের সামনে, বাগানে– বহু জায়গায় সে ফুলের দেখা পেলাম। মনে হলো, আমি যেন বাদুড় ফুলের রাজ্যে এসে পড়েছি। শত শত গাছ, সবটাতেই ফুটে রয়েছে অসংখ্য ফুল। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার পরও পেলাম সে ফুলের আহ্বান। যে টাওয়ার বিল্ডিংয়ে ছিলাম, তারই এক খোলা ব্যালকনিতে চারদিকে সারি করে লাগানো রয়েছে অনেক বাদুড় ফুলের গাছ। জলভেজা সবুজ পাতাগুলো চকচক করছে, সুতার মতো ফুলের পরাগকেশর বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টির জল নামছে। গাছের গোড়া থেকে মাঝখানে ৫০ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার লম্বা একটা ডাঁটির মাথায় কয়েকটি ফুল ফুটে রয়েছে। ফোটা ফুলগুলো বেশ বড়, কেশরসহ তার বিস্তার ২০ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার। সচরাচর স্বপরাগায়িত, তবে ফুলের দুর্গন্ধ অনেক সময় মাছিদের ডেকে আনে, মাছিরা তখন পরাগায়ন ঘটিয়ে চলে যায়। উদ্ভিদ রাজ্যে এরকম কিম্ভূতকিমাকার চেহারা ও রঙের ফুল আর আছে কিনা সন্দেহ। সাধারণত এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে ফুল ফোটে, তবে সেখানে আগস্টেও দেখলাম ফুলের প্রাচুর্য। একটি ডাঁটি বা পুষ্পমঞ্জরিতে কয়েকটি ফুল কয়েক দিন ধরে ফোটে। ফুল মরে গেলেও তা কেটে সরিয়ে ফেললে গাছের ক্ষতি হয় বা গাছ শুকিয়ে যায়।
বছর পাঁচেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে কয়েকটি বাদুড় ফুলের গাছ দেখেছিলাম, বর্ষাকালে সেসব গাছে ফুলও দেখেছিল। তবে সেসব ফুল দুসাইয়ের মতো বড় ও তাগড়াই গাছ ছিল না। এ গাছের পাতাগুলোও বেশ বড়, উপবৃত্তাকার, চকচকে, কিনারা সমৃণ, বোঁটা লম্বা। বাদুড় ফুলের গাছ কন্দজ, মাটির নিচে মেটে আলুর মতো গেঁড় বা গুঁড়ি হয়। সে মোথা বা গুঁড়ি তুলে লাগালে নতুন গাছ হয়। কখনও কখনও বীজ থেকেও এর চারা হয়। এ গাছ স্যাঁতসেঁতে জায়গা পছন্দ করে। একবার কোথাও লাগালে সেখানে ঝোপ করে বাড়তে থাকে। এ গাছের শত্রু হলো শামুক ও চাইটো। বাইরের বা ঘরের ভেতরে বাহারি গাছ হিসেবে একে লাগানো যায়। বিরুৎ শ্রেণির এ গাছের প্রজাতিগত নাম Tacca chantrieri ও গোত্র Dioscoreaceae– অর্থাৎ এরা মেটে আলু গোত্রীয় গাছ। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া তথা বাংলাদেশ, ভারতের আসাম, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশ এ গাছের আদি নিবাস। এ দেশের অরণ্যে বন্য পরিবেশে এক সময় দেখা গেলেও এখন লালিত বা চাষকৃত গাছ হিসেবে বাগানে শোভা পাচ্ছে, তবে খুব সুলভ নয়। বিপন্নতা এখনও যাচাই করা হয়নি।