সকালের নির্মল আলোয় যখন রাণাদহ বিল জেগে উঠছে, তখন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি কলরব করছে চারদিকে। পানকৌড়ি, কোড়া, ডাহুক, জলপিপি, শামুকখোল, সরালী, বালি হাঁস আর সাদা বকরা কখনো উড়ছে, কখনো আবার জলপদ্ম, মাখনা বা শালুক পাতায় ভর করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তবে এত পাখির ভিড়েও দেখা মিলছিল না এক অনিন্দ্য সুন্দর অতিথির—জলময়ূর। বিরল এই পাখির দেখা পেতে বিল পাড়ে অপেক্ষায় ছিলেন ঘাটাইল উপজেলার পাখিপ্রেমী ও সৌখিন ফটোগ্রাফার কামাল হোসেন। তিনি জানান, ‘টানা আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষার পর অবশেষে ক্যামেরায় ধরা পড়ে কাঙ্ক্ষিত জলময়ূর। একটি উড়ছিল, আরেকটি মাখনা পাতায় বসে ডাকছিল। এক জোড়া আবার খুনসুটিতে মত্ত ছিল।‘ বন বিভাগ ও পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, জলময়ূর দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিরল জলচর পাখি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Hydrophasianus chirurgus, ইংরেজি নাম Pheasant-tailed Jacana। ৩৯–৫৮ সেন্টিমিটার লম্বা এই পাখিটির লম্বা লেজ, সাদা ও বাদামি পালক, নীলচে ঠোঁট আর কালো পা একে করে তুলেছে অনন্য। জলময়ূর সাধারণত ভাসমান উদ্ভিদের (শাপলা, মাখনা, পদ্ম) পাতার উপর বাসা বাঁধে। স্ত্রী পাখি ডিম পেড়ে চলে যায়, আর পুরুষ পাখি তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায় এবং পরিচর্যা করে।
প্রাকৃতিক খাদ্য হিসেবে তারা পোকামাকড়, জলজ উদ্ভিদের কচি পাতা, অঙ্কুর ও বীজ খায়। ডিম ফুটে বের হওয়া বাচ্চারাও সঙ্গে সঙ্গে হাঁটাচলা ও সাতার কাটতে পারে। এক সময় পাহাড়ি জলাভূমি ছিল জলময়ূরের নিরাপদ আশ্রয়। তবে এখন অবৈধ শিকার, বাসস্থান ধ্বংস, এবং জমিতে বিষ প্রয়োগের কারণে তাদের অস্তিত্ব চরম হুমকিতে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) পাখিটিকে ‘নূন্যতম বিপদগ্রস্ত‘ তালিকাভুক্ত করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজ জামান বলেন, ‘জলময়ূরের প্রজনন ও বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ ও নির্দিষ্ট পরিবেশ প্রয়োজন। বসবাসের জায়গা সুরক্ষিত না হলে এরা হারিয়ে যাবে।‘ টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত প্রাচীন রাণাদহ বিল একসময় ছিল জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। বিলটির পাশেই কালীয়ান বিল ও গজারী বন। কিন্তু এখন বিলের বুক চিরে গেছে পাকা সড়ক, চারদিকে চলছে জবরদখল। শুষ্ক মৌসুমে পানির গভীরতায় ফেলা হচ্ছে চায়না ও কারেন্ট জাল, ধ্বংস হচ্ছে মাছ, পাখি ও জলজ প্রাণ। এর ফলে বিলের প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র চরম হুমকিতে পড়েছে। পাখিপ্রেমী কামাল হোসেন বলেন, ‘রাণাদহ বিলে এখনো কিছু মাখনা উদ্ভিদ টিকে থাকায় কয়েকটি জলময়ূর বেঁচে আছে। কিন্তু শিগগিরই এই বিলকে সংরক্ষিত, শিকার ও দখলমুক্ত ঘোষণা না করলে একদিন হয়তো এই অপূর্ব পাখিটিও হারিয়ে যাবে।