যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনির আখড়া–রায়েরবাজারের চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গণহত্যার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড র্যাব–১০ এর সাবেক সিও অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদ উদ্দিন একাধিক হত্যা মামলার আসামি হয়েও গত ছয় মাস ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ওই কর্মকর্তাকে রক্ষার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জুলাই–আগস্ট ২০২৪ ছাত্র আন্দোলনের সময় পতিত আওয়ামী লীগ সরকারকে রক্ষায় যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি নির্বিচারে গুলি করে কয়েক শত নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। আহত হন কয়েকশ আন্দোলনকারী। যদিও সরকার থেকে এখনো পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা জানানো হয়নি। এক পর্যায়ে হাজারো সাধারণ আন্দোলনকারী যাত্রাবাড়ী থানায় হামলা চালিয়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা ও অগ্নিসংযোগ করে। যাত্রাবাড়ী এলাকায় গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এরই মধ্যে ওই থানার তৎকালীন ওসি আবুল হোসেন এবং যাত্রাবাড়ী জোনের তৎকালীন সহকারী পুলিশ কমিশনার তানজিল আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অথচ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের জোরে রাঙ্গামাটি হিল ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে বহাল তবিয়তে রয়েছেন যাত্রাবাড়ী গণহত্যার অন্যতম ২৪তম বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তা, আন্দোলনকারীদের উপর গুলি বর্ষণের মাস্টারমাইন্ড র্যাব–১০ এর সাবেক সিও অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদ উদ্দিন। যারা গুলি করে ছাত্র–জনতাকে হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত এবং নির্দেশ দাতা তারা এখনো পলাতক।
অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদ উদ্দিন সম্পর্কে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাত্রাবাড়ী গণহত্যার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড র্যাব–১০ এর সাবেক সিও অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদ উদ্দিন ছাত্র–জনতার একাধিক হত্যা মামলার আসামি হয়েও তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ওই কর্মকর্তাকে রক্ষার চেষ্টা করছে বলে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। তার বর্তমান কর্মস্থল খাগড়াছড়ি এপিবিএন ট্রেনিং সেন্টার। সে ২০১৮ সালের রাতের ভোটের সময় ডিসি ওয়ারি ছিল। সে সময় বিএনপি–জামায়াতের নেতাদের গণ–গ্রেফতার করেছিল। ২০১৪–১৬ পর্যন্ত এডিসি মতিঝিল হিসেবে বিএনপি–জামায়াতের নেতাদের অত্যাচার করেছিল। সিলেটের এসপি থাকাকালীন অবৈধ টাকা দিয়ে রাজধানীর বেইলি রোডে ফ্ল্যাটসহ অনেক সম্পদের মালিক। তার ভাই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জুলাই–আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শুধু যাত্রাবাড়ী এলাকায় হত্যা করা হয়েছে ৪০০ মানুষকে। সেখানে পুলিশ সদস্য ছিলেন তিন থেকে ৫০০। তাদের সবাইকে ধরা হবে না। ধরা হবে তাদের কমান্ডারদের।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ও একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জুলাই–আগস্ট–২০২৪ গণ–অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর প্রধান প্রবেশ পথগুলোর মধ্যে অন্যতম স্পট যাত্রাবাড়ী। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে যাত্রাবাড়ী বিক্ষোভকারীদের অন্যতম ঘাঁটিতে পরিণত হয়। সে সময় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সদস্য এবং সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের আক্রমণের মুখে এলাকাটি প্রধান রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশ করতে হাজার হাজার মানুষ যাত্রাবাড়ী থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত চার কিলোমিটারের রাস্তায় অবস্থান নেয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শেখ হাসিনার অনুগত বাহিনীর সাথে তুমুল সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
স্থানীয়রা জানায়, যাত্রাবাড়ী ও এর আশেপাশের এলাকা, বিশেষ করে কুতুবখালী, কাজলা, শনির আখড়া, ডেমরা রোড এবং রায়েরবাগ এলাকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ কেন্দ্রে পরিণত হয়। তাদের প্রতিহত করতে ১৭ জুলাই পুলিশ আন্দোলনকারী জনগণের ওপর গুলি চালালে অনেকে নিহত হয়। একটি বাস কোম্পানির প্রাক্তন টিকিট মাস্টার মো. সফিকুল ইসলাম ছাত্র আন্দোলন কীভাবে গণ–অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল তার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ছাত্র আন্দোলনকারীদের উপর সরকারের বর্বরতার প্রতিবাদে আমার মতো সাধারণ মানুষও ১৭ জুলাই থেকে আন্দোলনে যোগ দেই। ১৭ জুলাই থেকে যাত্রাবাড়ীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’-এর মাধ্যমে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। চাকরিজীবী, দিনমজুর, দোকানদার, বাবুর্চি, দর্জি, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, গার্মেন্টস শ্রমিক, ফ্রিল্যান্সার, মাদরাসা ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দেন। স্তন্যদানকারী মাও এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী নিশ্চিত করেছেন, তিনি যাত্রাবাড়ীর ধোলাইরপাড় এলাকায় ছয় থেকে সাত মাস বয়সী শিশুকে কোলে নিয়ে একজন স্তন্যদানকারী মাকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারের দমন–পীড়নের বিরুদ্ধে রাস্তায় স্লোগান দিতে দেখেছেন। স্থানীয়রা জানায়, সরকার যখন ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে এবং সারা দেশে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে গণ–গ্রেফতার শুরু করে তখনো বিক্ষোভকারীরা এক মুহূর্তের জন্যও যাত্রাবাড়ী এলাকায় রাস্তা ছাড়েনি। কারফিউ জারির পরও যাত্রাবাড়ী ও এর আশপাশের এলাকায় টানা পাঁচ দিন ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হকার মো. হানিফ বলেন, সরকার যখন কারফিউ জারি করে শহরের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়, তখনো যাত্রাবাড়ী আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। পিকআপ ভ্যানচালক মো. রিপন বলেন, পুলিশ জনগণের ওপর এমন নির্বিচারে গুলি চালাতে পারে তা আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। কিন্তু এই গোলাগুলিই জনগণের মধ্যে একটি গুরুতর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। সেখানে যত বেশি হত্যাকা– সংগঠিত হয়েছে, তত বেশি মানুষ লড়াইয়ে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত হয়েছে। সেখানে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে, মনে হচ্ছিল এটি একটি যুদ্ধক্ষেত্র এবং কারো বাড়িতে থাকার সময় নেই।
এ বিষয়ে একাধিকবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সাথে যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর ইনকিলাবকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র–জনতার উপর হামলা ও হত্যার ঘটনার মামলাসমূহ পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে। ঘটনার সাথে সম্পৃক্তদের গ্রেফতারে পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে। পুলিশ সদস্যদেরকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলাসমূহের তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তদন্তে যাদেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।