পেঁয়াজের ভান্ডার বলে পরিচিত পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলায় একদিকে চলছে মুড়িকাটা পেঁয়াজ তোলা ও অন্যদিকে চলছে হালি পেঁয়াজের আবাদ। প্রতিবছরের মতো এই সময়ে এবারও সেখানে শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে শ্রমিকের মজুরিও বেড়েছে। এমন অবস্থায় বিভিন্ন স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এসেছে পেঁয়াজ রোপণ ও তোলার কাজে। এতে শিক্ষার্থীরা যেমন বাড়তি আয়ের সুযোগ পেয়েছে, তেমনি কৃষকেরাও বেশি দামের শ্রমিকের পরিবর্তে অল্প খরচে পেঁয়াজের আবাদ করতে পারছেন।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলায় দুই পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়ে থাকে। এর একটি হলো আগাম বা মুড়িকাটা পেঁয়াজ এবং অপরটি হলো হালি পেঁয়াজ। মুড়িকাটা পদ্ধতিতে অক্টোবর–নভেম্বর মাসে পেঁয়াজের আবাদ করে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে পেঁয়াজ ঘরে তোলা হয়। অন্যদিকে হালি পদ্ধতিতে ডিসেম্বর–জানুয়ারি মাসে পেঁয়াজের আবাদ করে মার্চ–এপ্রিলে পেঁয়াজ ঘরে তোলা হয়। পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়ার কৃষকেরা এখন একদিকে মুড়িকাটা পেঁয়াজ জমি থেকে ঘরে তুলছেন, অন্যদিকে হালি পেঁয়াজ জমিতে লাগাচ্ছেন। ফলে এখন কৃষিশ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা দেখা দিয়েছে।
কৃষকেরা জানান, এবার প্রকৃত কৃষিশ্রমিকেরা পেঁয়াজ তোলা অথবা রোপণের জন্য প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা নিচ্ছেন। তা–ও ঠিকমতো শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ স্থানীয় স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দৈনিক মজুরিতে পেঁয়াজ তোলা ও রোপণের কাজ করছে। এতে কৃষক ও শিক্ষার্থী উভয়ই লাভবান হচ্ছে। পেঁয়াজের খেতে কাজ করা শিক্ষার্থীরা জানায়, মূলত অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরাই শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। এর মধ্যে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অনেকেই স্কুল থেকে সব বই পায়নি। বছরের শুরু বলে তাদের ক্লাসও পুরোদমে হচ্ছে না। ফলে তারা টানা পেঁয়াজখেতে কাজ করতে পারছে। অন্যদিকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কলেজ খোলা থাকলেও পড়াশোনা নিয়ে তারা কিছুটা চাপমুক্ত রয়েছে। ফলে তারাও পড়াশোনার ফাঁকে পেঁয়াজখেতে সারা দিনব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে। বেড়া উপজেলার চাকলা ও সাঁথিয়া উপজেলার পুরিয়া গ্রামে দলে দলে হালি পেঁয়াজের চারা রোপণ করছে শিক্ষার্থীরা।
সাঁথিয়া উপজেলার পুরিয়া গ্রামের পেঁয়াজের খেতে চারা রোপণ করতে আসা নবম শ্রেণির ছাত্র সজীব হোসেন বলে, ‘ইশকুলে এখন তেমন ক্লাস হতেছে না। এই ফাঁকে প্রায় ১০ দিন ধইর্যা আশপাশের কৃষিজমিতে দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরিতে পেঁয়াজের লাগানোর কাজ করতেছি। এই মৌসুমে আরও অন্তত ১০ দিন কাজ করার আশা করতেছি। যে টাকা আয় হবে, তা দিয়্যা পড়াশোনার খরচ বহনের পাশাপাশি পরিবারেরও কিছু খরচ মিটাতে পারব।’ অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিয়াদ হোসেন বলে, ‘এখন তেমন ক্লাস হচ্ছে না। পড়াশোনার চাপও কম। তাই পেঁয়াজের খেতে কাজ করতেছি। ইশকুলের ড্রেস, জুতা, গাইড কিনার খরচ ইতিমধ্যেই পায়া গেছি। বাকি যা পাব, তা বাবা–মায়ের হাতে দেব।’
বেড়া উপজেলার চাকলা গ্রামের মোল্লাপাড়া ফসলের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, দল বেধে পেঁয়াজের চারা লাগানোর কাজ করছে ১০ থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী। পেঁয়াজখেতের মালিক কৃষক আরিফ হোসেন বলেন, ‘এলাকায় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার নিচে কৃষিশ্রমিক পাওয়া যাতেছে না। তারপরও সব সময় তাঁদের পাওয়া যায় না। এ অবস্থায় ৬০০ টাকা মজুরিতে এলাকার শিক্ষার্থীরা জমিতে পেঁয়াজের জমি প্রস্তুত করার পাশাপাশি চারা লাগিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কৃষিশ্রমিকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। শিক্ষার্থীরা আবাদে সাহায্য করায় তাদের আর আমাগরে দুই পক্ষেরই লাভ হতেছে।’
বিষয়টিকে ইতিবাচক বলে উল্লেখ করে সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জীব গোস্বামী বলেন, ‘সাঁথিয়ায় এখন অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশে মুড়িকাটা পেঁয়াজ তোলা ও হালি পেঁয়াজের আবাদ চলছে। উপজেলার মোট মুড়িকাটা পেঁয়াজের ৪০ ভাগ ইতিমধ্যে উঠে গেছে। অন্যদিকে হালি পেঁয়াজের প্রায় ৯০ ভাগ চারা লাগানো শেষ। এ সময় শ্রমিকের চরম চাহিদা থাকে। এই সময়ে শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে কৃষকের জমিতে পেঁয়াজ লাগানো ও তোলার কাজ করছে দেখে খুব ভালো লাগছে। এখন যেহেতু শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চাপ কম, তাই তারা পেঁয়াজখেতে কাজ করে নিজেদের পড়াশোনার খরচ যেমন জোগাড় করছে, তেমনি কৃষকদের উপকারও করছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, শিক্ষার্থীরা হাতেকলমে কৃষির অন্যতম একটি পদ্ধতি শিখতে পারছে।’