সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের নিলামে বিক্রি হওয়া এ স্থাপনাটি ভাঙতে গিয়ে বের হওয়া সুড়ঙ্গ ঘিরে এলাকায় চলছে নানা আলোচনা। এ নিয়ে পুরোনো ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় জেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ বুধবার (৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় বাড়িটি ভাঙার কাজ স্থগিতের কথা জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। এর আগে গত মঙ্গলবার ওই বাড়িটি ভাঙতে গিয়ে সুড়ঙ্গ পাওয়া যায়। পরে এ নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বিশিষ্ট গবেষক ও রাজশাহী এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ড. তসিকুল ইসলাম রাজা বলেন, এই বাড়ির প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে। সংরক্ষণ করা উচিত ছিল সরকারের। বাড়িটি ভাঙার তদারকিতে থাকা মো. অপু বলেন, ‘এই সুড়ঙ্গ প্রাকৃতিক এসি।
আগের দিনে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ঘরের নিচে সুড়ঙ্গ রাখতেন। তাতে পানি জমে ঘর ঠাণ্ডা রাখত।’ প্রত্নতত্ত্ববিদরা জানান, রাজশাহী বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শহর। এই শহর প্রাচীন বাংলায় পরিচিত ছিল। রাজশাহী শহরে ও নিকটে প্রাচীন বাংলার বেশ কয়েকটি রাজধানী অবস্থিত। প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজশাহী ছিল প্রাচীন বাংলার পুণ্ড্র সাম্রাজ্যের অংশ। বিখ্যাত সেন বংশের রাজা বিজয় সেনের রাজধানী ‘বিজয়নগর’ রাজশাহী শহর থেকে মাত্র ৯ কিমি পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। মধ্যযুগে রাজশাহী পরিচিত ছিল রামপুর বোয়ালিয়া নামে। এই সূত্রে রাজশাহী শহরের একটি থানার নাম বোয়ালিয়া। এরকম একটি ঐতিহ্যমন্ডিত শহরে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি বসবাস করেছেন এবং তাদের স্মৃতিবিজরিত বাসস্থান রয়েছে। এমন একটি ‘ঐতিহাসিক’ বাড়ির অবস্থান রাজশাহীর দরগাপাড়ায়। বাড়িটি বানিয়েছিলেন দিঘাপতিয়ার রাজা হেমেন্দ্র কুমার রায়ের ছেলে সন্দীপ কুমার রায়। জনশ্রুতি আছে মহারানি হেমন্তকুমারী (১৮৬৯–১৯৪২) পুঠিয়া থেকে রাজশাহী শহরে এলে এই বাড়িতে থাকতেন। বাড়িটির সামনে একটি নাগলিঙ্গম ফলের গাছ আছে।
ভবনটি সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য যাচাই ছাড়াই নিলামে তোলা হয়েছে। ভূমি অফিস জানায়, জমির মালিক ছিলেন সন্দীপ কুমার রায়। তার বাবা রাজা হেমেন্দ্র নারায়ণ রায়। নথি অনুযায়ী মালিকের ঠিকানা দিঘাপতিয়া স্টেট, বলিহার, নাটোর। রাজা হেমেন্দ্র রায় ছিলেন দিঘাপতিয়ার রাজবংশের রাজা প্রমথ নাথের চার ছেলের একজন। সূত্র মতে, ১৯৮১ সালে জমিটি শত্রু সম্পত্তি (ভিপি) ঘোষণা করা হয়। অথচ সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশে, ‘১৯৭৪ সালের পর কোনো সম্পত্তি ভিপি ঘোষণা করা যাবে না’ বলা হয়েছে। ১৯৭২ সালের আরএস রেকর্ডে মালিক সন্দীপেরই নাম রয়েছে। বাড়িটি প্রয়াত ভাষাসৈনিক মনোয়ারা রহমানের বরাবরে ইজারা ছিল। ইজারা বাতিল করে স্থাপনা অপসারণে সম্প্রতি মাত্র ১ লাখ ৫২ হাজার টাকায় নিলামে তোলা হয়েছে। এদিকে বুধবার দুপুরে জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নাগরিক সমাজ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মী এবং রাজশাহীর ইতিহাস–ঐতিহ্যের গবেষকদের পক্ষে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এসময় পঞ্চকবির অন্যতম রজনীকান্ত সেনের বসতভিটা, মিঞাপাড়ায় রাজা হেমেন্দ্র কুমারের বসতভিটা, উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটকের বসতভিটা ও তালন্দ ভবনসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণের দাবি জানানো হয়। রাজবংশের এই স্মৃতিচিহ্ন নিলামে বিক্রি করার বিষয়ে ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ হোসেন বলেন, ‘এটার কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব আছে কি না, তা জানা নেই। আগে জানালে আমরা ভেঙে ফেলতাম না।’ রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. আ.ন.ম বজলুর রশীদ বলেন, ‘বাড়িটির ব্যাপারে আমার ধারণা ছিল না।
বোয়ালিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সিটি কর্পোরেশনকে বলেছি, বিষয়টি দেখার জন্য।’ এদিকে বিষয়টি আলোচনায় আসার পর দিঘাপাতিয়ার রাজা হেমেন্দ্র কুমার রায়ের ছেলে সন্দীপ কুমার রায়ের বাড়িটি আর না ভাঙার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। স্থাপনাটির প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য যাচাইয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বুধবার দুপুরে নগরের দরগাপাড়া মৌজায় ওই বাড়িতে গিয়ে ভাঙার কাজ বন্ধ করে দেন বোয়ালিয়া থানা ভূমি অফিসের কর্মচারীরা। অবশ্য পাশাপাশি দোতলা দুটি বাড়ির প্রায় সবই ভেঙে ফেলা হয়েছে। শুধু মেঝের নিচে থাকা সুড়ঙ্গের ইটগুলো তোলা বাকি। রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মহিনুল ইসলাম বলেন, আমরা বাড়িটির ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছি। বাড়িটির কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য আছে কি না, যাচাই করার জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। তারা এসে বিষয়টি যাচাই করে দেখবেন। প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য থাকলে পরামর্শ অনুযায়ী বাড়িটি সংরক্ষণ করা হবে।


