পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৮ বছর পূর্তি হলেও তিন পার্বত্য জেলায় এখনো চাঁদাবাজি একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতা। এখানকার মানুষ ছয় সন্ত্রাসী সংগঠনের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ। ওই সংগঠনের সদস্যরা ৪১টি খাত থেকে বছরে চাঁদা আদায় করছে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। ওই চাঁদার টাকা তারা বিদেশেও পাঠাচ্ছে। এভাবে দেশ–বিদেশে বিলাসী জীবন যাপন করছে তারা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র, স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র বলছে, সামনের নির্বাচনকে টার্গেট করে চাঁদাবাজি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে সংগঠনগুলো। জেএসএস ও ইউপিডিএফ আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
যেসব সংগঠন আদায় করছে চাঁদা
এক্স–ফোর্সেস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, জেএসএস (সন্তু) বছরে ৪৫০ কোটি টাকা, ইউপিডিএফ (প্রসীত) ৩৫০ কোটি টাকা, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ১৫০ কোটি টাকা, জেএসএস (সংস্কার) ১৫০ কোটি টাকা, এমএনপি ৫০ কোটি টাকা এবং কেএনএফ ৫০ কোটি টাকার মতো চাঁদা আদায় করে। সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভ্যাট–ট্যাক্স মওকুফ করলেও তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে ছয়টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে খুন, গুম
চাঁদাবাজির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন হয় না বলে জানান ভুক্তভোগীরা। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে তাদের নির্যাতন, ঘর পোড়ানো, অপহরণ, হত্যা, গুম করা হয়। এ কারণে তাঁরা নীরবে চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন এবং বেশির ভাগ সময় আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকেও বিষয়টি জানান না। চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে গত এক বছরে আন্তঃ সংঘর্ষে ৩৭ জন খুন হন এবং অপহরণ ও গুমের শিকার হয়েছেন প্রায় ১৫০ জন। আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, স্থানীয় ব্যবসায়ী, ঠিকাদারদের তথ্য মতে, এই চক্রগুলো পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, বনজীবী এমনকি সবজি ও ফল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা আদায় করে। বিশেষ করে সড়ক নির্মাণসহ উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলো থেকে শতকরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চাঁদা তোলে তারা। এ ছাড়া আকারভেদে প্রতিটি পরিবহন থেকে চাঁদা নেওয়া হয়। সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, বান্দরবানের সদর, লামা, রোয়াংছড়ি, থানচি, রুমা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলা সদরসহ প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে চাঁদা এখন একপ্রকার অঘোষিত ‘ট্যাক্সে’ পরিণত হয়েছে। কাঠ, বাঁশ, পরিবহন, হোটেল ব্যবসা—সবকিছুতেই চাঁদা আদায়ের অভিযোগ শোনা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বান্দরবান পরিবহন সমিতি, হোটেল–মোটেল মালিক সমিতির সদস্য, ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীরা বলেন, চাঁদা কারা নেয় তা নির্ভর করে এলাকার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে রয়েছে তার ওপর। সশস্ত্র গ্রুপগুলো ছাড়াও কিছু রাজনৈতিক দলের নেতারাও নানা কৌশলে চাঁদাবাজি করছেন। অতি সম্প্রতি সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ির রিজিয়নস কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ বলেন, পাহাড়ে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ অটুট রাখতে সেনাবাহিনী নিরলসভাবে কাজ করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও উন্নয়নে পাহাড়ি–বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি দমনে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) বান্দরবান জেলা শাখার বেশ কয়েকজন নেতা জানান, জেএসএস একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল, সন্ত্রাসী সংগঠন নয়। দলটি যাতে ভূমিসহ নানা অধিকার নিয়ে সোচ্চার না হতে পারে, সে জন্যই তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করা হয়।
বিগত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার জেএসএসের বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা মামলা দিয়েছে। তাঁদের অন্তত এক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কে এস মং বলেন, ‘স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার আমাকে হয়রানি করতে হত্যা, চাঁদাবাজি, অপহরণের পাঁচটি মিথ্যা মামলা দিয়েছে। ওই মামলায় কারাবরণও করতে হয়। এরই মধ্যে দুটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন হয়ে গেছে। একটিতেও আমাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি। এভাবে জেএসএসকে হেয় করতে ও নেতাকর্মীদের হয়রানির উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত অপপ্রচার চালানো হয়।’ বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফরহাদ সরদার বলেন, ‘পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রধারী কোনো গোষ্ঠীকে ছাড় দেওয়া হবে না। এ ছাড়া চাঁদাবাজি, অপহরণ, মারধর, হত্যাকাণ্ড বা হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ও তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’



