লোকসাহিত্য বিশারদ আবুল আহসান চৌধুরী বলেছেন, লালনকে শুধু এই গানের মানুষ ভাবলে চলবে না। লালনের গানের ভেতরে একটা বাণী আছে, একটা শিক্ষা আছে। তিনি শুধু সাধনার গান লিখে যাননি। তিনি জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণভেদের বিরুদ্ধে তার গানের ভেতর দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সেজন্য লালনের এই ঐতিহাসিক অবদান– বাঙালি জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক বলে আমি মনে করি। তাই, লালনকে আমি আমার মত করে বলি যে, লালন ছিলেন একই সঙ্গে মরমী ও দ্রোহী। গতকাল বৃহস্পতিবার লালন সাঁইয়ের ১৩৬তম তিরোধান দিবস নিয়ে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, বর্তমানের চোখ দিয়ে বিচার করলে লালনকে ঠিকভাবে বোঝা যাবে না, বোঝানোও যাবে না। লালনকে বুঝতে হলে তার সময়ে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৭৭৪ সালের দিকে।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে ওই বছরেই বা তার দু’বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি আরও বলেন, রাজা রামমোহন রায় বাংলার নবজাগরণের রীতি প্রবর্তক। কিন্তু এই বিষয়টি যদি আমরা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখি, তার সুবাদে বাঙালি সমাজে একটা জাগরণ এসেছিল। সেই জাগরণ ছিল খুবই খণ্ডিত, খুবই একপেশে এবং একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে। সেখানে সম্পূর্ণ বাঙালির অংশ ছিল না। আবুল আহসান চৌধুরী আরও বলেন, রামমোহন ও তার অনুসারীরা কলকাতা মহানগরকে কেন্দ্র করেই তাদের নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন এবং তার বিস্তার সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়েনি। এটা খুব সীমিত ক্ষেত্রে ছিল। অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল বিশাল বাংলার গ্রাম। অর্থ্যাৎ, পাঁচ ভাগের চার ভাগই ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, সেখানে কোনো আলো পৌঁছায়নি। আবার বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়েরও এই জাগরণের সঙ্গে কোনো সংযোগ সম্পৃক্ততা ছিল না। গ্রামীণ বাংলার নবজাগরণের নায়ক হচ্ছেন লালন। তখন সমাজটা কেমন ছিল, সেটি বুঝতে পারলে লালনের কাজের মূল্যায়ন করা খুব সহজ হবে। একদিকে রাজা রামমোহন রায় যেমন নাগরিক বাংলার নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন, লালন ফকির গ্রামীণ বাংলার নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন। পাশাপাশি রামমোহন ও তার অনুসারীদের অল্পবিস্তর বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
কিন্তু লালন ফকিরকে নিদারুণ বিরোধিতা, নির্যাতন, নিগ্রহের মুখোমুখি হতে হয়েছে। একেবারে প্রথম থেকেই লালনের বিরুদ্ধে সমাজ, সমাজপতিরা সজাগ ছিলেন। এর ফলে লালন ও তার অনুসারীরা বারবার নিগৃহীত, নির্যাতিত হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে পরে ফতোয়া জারি হয়েছিল– বাউল ধ্বংস ফতোয়া। তার মূল লক্ষ্যে ছিলেন লালন ফকির। লালন তার সমকালেও নিন্দিত ও সমালোচিত হয়েছেন নানাভাবে। এ বিষয়ে আমার বইয়ে বিশদ আলোচনা আছে। এই লোকসাহিত্য বিশারদ বলেন, এখন প্রশ্ন আসে– কেন লালন আক্রান্ত হলেন, কেন একতারার বিরুদ্ধে লাঠির সংগ্রাম শুরু হলো। কারণ, তিনি সামাজিক জড়তা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তখন তো জাত ধর্ম দিয়েই মানুষকে বিচার করা হতো। কে কোন জাতের, উঁচু–নিচু, তারপরে ছোঁয়াছুঁয়ির একটা ব্যাপার ছিল, অস্পৃশ্যতা ছিল। অথচ লালন তো মরমী সাধক। তার তো কেবল এই মরমের গান, দেহতত্ত্বের গান রচনা করে যাওয়াই উচিত ছিল, সেটাই কথা ছিল। কিন্তু লালন সমাজের দিকেও চোখ ফিরিয়েছিলেন। আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, সমাজকেও তিনি খোলা মনে, খোলা চোখে দেখেছিলেন।
তাইতো যখন তিনি লোকজনের মুখোমুখি হয়েছেন, ‘জাত’ কেন্দ্রিক প্রশ্নের, তখন তিনি অনায়াসে সাবলীলভাবে বলেছেন যে, ‘লালন জাত মানে না, লালনের কোনো জাত নেই।’ এবং তিনি যুক্তি দিয়ে এসব কথা বলতে পেরেছেন ও বলেছেন, ‘জাত না গেলে পাইনে হরি, কি ছার জাতের গৌরব করি, ছুঁসনে বলিয়ে। লালন কয় জাত হাতে পেলে, পুড়াতাম আগুন দিয়ে।’ তিনি আরও বলেন, লালন ফকিরের জীবন দর্শনভিত্তিক কথা সেকালে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এবং দলে দলে যারা নির্যাতিত, নিম্নবর্গের মানুষ– তারা লালনের এই কথায়, এইসব বাণীতে, গানে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তারা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে অনুসারী ও ভক্ত হয়েছিলেন। সেজন্য লালন বাঙালি সমাজের এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে গেছেন। যা কেবল আমাদের সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে যে উল্লেখযোগ্য তা নয়। বরং এটি আমাদের সামাজিক ইতিহাসের দিক দিয়েও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাকে নিয়ে সঠিক আলোচনা ও মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ একেবারেই হয়নি।