চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার মানিকপুর গ্রামের এই কৃষি উদ্যোক্তা বলেন, ‘বর্তমানে ৩৫ বিঘা জমিতে আমার ফলের বাগান রয়েছে। বাগান মূলত মালটার। এর ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ফল যেমন ড্রাগন, কমলা ও আঙুর রয়েছে। বলতে গেলে মিশ্র ফলের বাগান। ২০১৪ সালে চাষ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত শুধু মালটা বিক্রি করেছি প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ টাকার। অন্যান্য ফল বিক্রি হয়েছে প্রায় ৭৫ লাখ টাকার।’ এ বছর জীবননগরে ২৩২ হেক্টর জমিতে মালটার আবাদ হচ্ছে। জমির দিক থেকে জেলার মধ্যে এ উপজেলা এই ফল চাষে এগিয়ে। তবে দেশের সবচেয়ে বড় মালটার বাগান রয়েছে দামুড়হুদা উপজেলায়। জেলার অন্য দুই উপজেলায়ও প্রচুর মালটার চাষ হচ্ছে। এই ফল চাষে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন চুয়াডাঙ্গার চাষিরা। এক সময় ৯ বিঘা জমিতে পেয়ারার বাগান ছিল সজল হোসেনের। তেমন লাভ না হওয়ায় ২০১৪ সালে পেয়ারা গাছ কেটে সেখানে মালটা চাষ শুরু করেন। প্রথম দুই–এক বছর তেমন লাভের মুখ দেখেননি সজল।
এরপর বাড়তে থাকে আয়। সেই সঙ্গে বিস্তৃত হতে থাকে তাঁর মালটার আবাদ। জেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, চুয়াডাঙ্গার চারটি উপজেলায় মোট ৯৭৫ জন মালটা চাষি রয়েছেন। তারা ৩২৬ হেক্টর জমিতে এর চাষ করছেন। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদরে ২০ হেক্টর, দামুড়হুদায় ৪৬ হেক্টর, আলমডাঙ্গায় ২৮ হেক্টর। চলতি মৌসুমে মোট মালটা উৎপাদন হয়েছে ৪ হাজার ১৬০ টন। বিক্রি হয়েছে প্রায় ২১ কোটি টাকার।
মালটা চাষে উদ্যোক্তা তৈরির ‘কারিগর’ বাবুল
মালটার কথা উঠলেই চুয়াডাঙ্গার চাষিদের মুখে বাবুলের নাম শোনা যায়। তাঁর পুরো নাম সাখাওয়াত হোসেন বাবুল। দামুড়হুদা উপজেলার নতিপোতা ইউনিয়নের হোগলডাঙ্গা, নতিপোতা ও ভগীরথপুর– এই তিন গ্রামে বয়ে গেছে মরাগাঙ নদী। ওই নদীর পাশে ৪০ বিঘা জমিতে জেলায় প্রথম মালটার বাগান গড়ে তোলেন ভগীরথপুর গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা বাবুল। ২০১৩ সালের শেষ দিকে তিনি খুলনা কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে দুই হাজার টাকায় ২০টি বারি মালটা–১ জাতের চারা কিনে আনেন। তাঁর হাত ধরেই চুয়াডাঙ্গায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে মালটার আবাদ শুরু। কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে তিনি দেশের সবচেয়ে বড় মালটা বাগান মালিকের স্বীকৃতি এবং জাতীয়ভাবে পুরস্কার পান।
মালটা চাষ নিয়ে দিন দশেক আগে বাবুলের সঙ্গে কথা হয় সমকাল সাংবাদিকের। গত ১৩ অক্টোবর অসুস্থ হয়ে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। মালটা চাষ সম্পর্কে সাখাওয়াত হোসেন বাবুল বলেছিলেন, তিনি সরকারি চাকরি করতেন। তবে কৃষির প্রতি আলাদা টান ছিল। সেই টান থেকে মালটা চাষ শুরু।
২০১৭ সাল থেক মালটা বাজারজাত করতে থাকেন। মোট ৪৬ বিঘা জমিতে তিনি গড়ে তোলেন দেশের সবচেয়ে বড় মালটা বাগান। বাবুল জানিয়েছিলেন, চার হাজার টাকা মণ দরে পাইকাররা বাগান থেকেই কিনে নিয়ে যায় মালটা। এ গাছের চারাও বিক্রি করেন তিনি। ছোট চারা ৮০ থেকে ১০০ এবং বড় আকারের চারা দেড়শ থেকে ২২০ টাকা করে বিক্রি হয়। চারা বিক্রি করে আয় হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা।
ভগীরথপুর থেকে পুরো জেলায় ছড়িয়েছে মালটার চাষ
বাবুলের দেখাদেখি মালটা চাষ শুরু করেন দামুড়হুদার হাউলী ইউনিয়নের ডাক্তারপাড়ার আব্দুল আলীম। তিনি নিজ গ্রামের বারুইপাড়া মাঠে ১২ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেন এই ফলের বাগান।
আব্দুল আলীম জানান, ২০১৪ সালে এলাকার বিভিন্ন চাষির কাছ থেকে ভালো জাতের মালটার চারা সংগ্রহ করেন। মালটা বাজারজাত শুরু করেন ২০১৯ সালে। এ বছর প্রায় ১৩ লাখ টাকার মালটা বিক্রি করেছেন তিনি। আলীম বলেন, ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা কেজি দরে পাইকাররা বাগান থেকেই কিনে নিয়ে যায়। বাগানে এখনও ৪–৫ লাখ টাকার মালটা রয়েছে। জীবননগর উপজেলার হাসাদহ গ্রামের চাষি আশরাফুল ইসলাম জানান, ২০১৭ সালে মালটা চাষ শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে জমি লিজ নিয়ে বর্তমানে ২০ বিঘা জমিতে এই ফলের বাগান গড়ে তুলেছেন। জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আলমগীর হোসেন জানান, দামুড়হুদা উপজেলায় দেশের সবচেয়ে বড় মালটার বাগান থাকলেও জীবননগর উপজেলায় এই ফলের উৎপাদন বেশি।
চাষ পদ্ধতি ও বাজার ব্যবস্থাপনা
দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার জানান, উঁচু জমিতে মালটার উৎপাদন ভালো হয়। পাঁচ–ছয় হাত দূরত্বে গাছের চারা রোপণ করতে হয়। চারা লাগানোর ১৮ মাসের মাথায় ফল আসতে শুরু করে। এর চারা সহজে মরে না। তুলানামূলক রোগ–বালাইও কম। মাইট (মাকড়) আক্রমণ দেখা দিলে প্রতিরোধের জন্য সঠিক সময়ে এবামেকটিন গ্রুপের মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে। একটি মালটা গাছ থেকে বছরে ৩০০–৩৫০টি ফল পাওয়া যায়। শারমিন আক্তার আরও জানান, আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে মালটা সংগ্রহ করা যায়। অধিক মুনাফার আশায় অনেকেই আগেভাগে মালটা বাজারজাত করে থাকেন। যে কারণে এই ফলের আসল স্বাদ ভোক্তারা পান না। যদি আগস্টের শেষভাগ থেকে মালটা বাজারজাত করা হয়, তাহলে ক্রেতারা আর বিদেশ থেকে আমদানি করা মালটা নিতে চাইবে না।
কারণ দেশি মালটার স্বাদ ও রস দুটোই বেশি। দামের দিক থেকেও অনেকটা কম। স্থানীয় চাষিরা জানান, জেলায় ব্যাপক হারে মালটার আবাদ হওয়ায় স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন এলাকায় বাজার সৃষ্টি হয়েছে। আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা সদর, দামুড়হুদা উপজেলার দামুড়হুদা, কার্পাসডাঙ্গা, দর্শনাসহ জীবননগর উপজেলার হাট–বাজারে মালটার দোকান দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া আন্দুলবাড়িয়া, কোটচাঁদপুর, রায়পুর, সাহাপুর, সাবদাল– এসব স্থানীয় বাজারেও মালটা বিক্রি হচ্ছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার জানান, চুয়াডাঙ্গায় বারী–১, বারী–২, বারী–৩, গ্রেড গ্রিন রুবি, মরক্কো, পাকিস্তান, আফ্রিকা, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন জাতের মালটার চাষ হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মালটা সরবরাহ করা হচ্ছে। জেলার কৃষি অর্থনীতিতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভূমিকা রাখছে এই ফল।
কদর বেড়েছে দেশি মালটার
দেশি ও আমদানি করা বিদেশি মালটার রং, স্বাদ ও বাজারদরের মধ্যে বেশকিছু পার্থক্য রয়েছে বলে জানালেন দামুড়হুদার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমদানি করা অধিকাংশ মালটার রং হলুদ এবং দেশি মালটার রং সবুজ–হলুদে মেশানো। বিদেশি মালটার চেয়ে দেশি মালটার বাজারদর অনেকটাই কম। এ কারণে দেশি মালটার কদর বেড়েছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অভিজিত কুমার বিশ্বাস জানান, মালটায় প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে, যা মানবদেহের জন্য খুব উপকারী।
কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে মালটা চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। দেশের প্রতিটি জেলা–উপজেলায় মালটার খুচরা ও পাইকারি বাজার গড়ে উঠলেও প্রক্রিয়াজাতসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে এখন পর্যন্ত বিদেশে রপ্তানি শুরু হয়নি বলে জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে। স্থানীয় চাষিরা জানান, মালটা চাষ লাভজনক হওয়ায় পুরুষের পাশাপাশি নারী এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এই ফল চাষে ঝুঁকছেন। তাদের মধ্যে দামুড়হুদার ইব্রাহিমপুর গ্রামের হিজড়া রিনি ছয় বিঘা জমিতে মালটার চাষ করে এলাকায় সাড়া ফেলেছেন।
তিনি বলেন, আর ১০ জন হিজড়ার মতো চলাফেরা না করে কৃষি কাজকেই জীবিকার জন্য বেছে নিয়েছি। মালটা চাষ ঘিরে সফলতার স্বপ্ন দেখছি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার জানান, চুয়াডাঙ্গায় প্রচুর মালটা আবাদ হচ্ছে। এই ফল উৎপাদনে সরকারিভাবে কোনো র্যাঙ্কিং এখন পর্যন্ত প্রকাশ হয়নি। তবে মালটা চাষে চুয়াডাঙ্গা জেলা সবচেয়ে এগিয়ে।