জালের মতো জড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের নদীপথগুলো যোগাযোগ ও বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এখন নদীগুলো যেন অপরাধী চক্রের কাছে লাশ ফেলার ‘ডাম্পিং স্টেশন’ হয়ে উঠেছে। গত দেড় বছরে নদী থেকে ৭৫০টি মরদেহ উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অর্থাত্ প্রতি মাসে গড়ে ৪২টি মরদেহ মিলছে নদীতে। এর মধ্যে ৩৯১টির পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। দীর্ঘ সময় পানিতে থাকার কারণে এসব মরদেহ শনাক্তে সমস্যা দেখা দেয়। মূলত হত্যার পর প্রমাণ লোপাট এবং আইনের চোখ ফাঁকি দিতেই মরদেহগুলো ফেলে দেওয়ার জন্য নদীকে বেছে নিচ্ছে খুনিরা। গত ২৩ আগস্ট বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী কেরানীগঞ্জের মীরেরবাগ এলাকা থেকে ভাসমান অবস্থায় গলায় কালো কাপড় প্যাঁচানো এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহ উদ্ধারের এক ঘণ্টা পরে একই স্থানে ওড়না দিয়ে প্যাঁচানো অবস্থায় এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে নৌ– পুলিশ।
একই দিনে মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে একই নদী থেকে হাত–পা বাঁধা অবস্থায় এক যুবক ও এক যুবতির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ময়নাতদন্তে প্রাথমিকভাবে উঠে আসে, হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে নদীতে। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ২৬ দিনেও তাদের পরিচয় মেলেনি। পুলিশ জানিয়েছে, আঙুলের ছাপ মুছে যাওয়ায় নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পুলিশের ভাষ্য, কেউ মরদেহ নিতেও আসেনি। পুলিশ দুই জনের ডিএনএ সংরক্ষণ করেছে। কেউ মরদেহ শনাক্ত করতে এলে মিলিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন থানায় নিখোঁজ ডায়ারির সঙ্গে তাদের তথ্য মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। নৌ–পুলিশের সদরঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোহাগ রানা জানিয়েছেন, সাধারণত পরিচয় জানা সম্ভব না হলে তদন্তে অগ্রগতি হয় না। হত্যার সূত্র খুঁজে পেতে পরিচয় শনাক্ত করা জরুরি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নদী থেকে উদ্ধার মরদেহ শনাক্ত করতে প্রায়ই পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। এটি একটি নিয়মিত চ্যালেঞ্জ। পুলিশ ও অপরাধতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ গ্রেফতার এড়াতে অপরাধীরা মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়। চলতি বছর প্রতি মাসে নৌ–পুলিশ গড়ে ৪৩টি মরদেহ উদ্ধার করেছে। গত বছর প্রতি মাসে এই সংখ্যা ছিল ৩৬টি। নৌ–পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশ জুড়ে অন্তত ৩০১ নারী–পুরুষ ও শিশুর মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে সর্বোচ্চসংখ্যক ৩৪টি মরদেহ পাওয়া গেছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। সেখানে ৩২টি মরদেহ উদ্ধার হয়েছে এই সময়ের মধ্যে। এর মধ্যে ২০৯ জনের পরিচয় জানা গেলেও ৯২ জন এখনো অজ্ঞাত। গত বছর নদী থেকে ৪৪০টি মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল, যার মধ্যে ১৪১ জনের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি। মরদেহ উদ্ধারের পর এ বছর বিভিন্ন থানায় অন্তত ৪১টি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে।
গত বছর ৫৩টি মামলা হয়েছিল। নৌ–পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, মরদেহের অবস্থা ও পারিপার্শ্বিক প্রমাণ সাপেক্ষে সন্দেহজনক মনে হলে তারা হত্যা মামলা দায়ের করেন। তবে হত্যার প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় একটি মস্তকহীন মরদেহ পাওয়া যায়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সহায়তায় আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেখা যায়, নিহত ব্যক্তির নাম হাবিব (২৭)। তিনি সোনারগাঁ উপজেলার মধ্য কাঁচপুর এলাকার বাসিন্দা। এটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড। নিহত ব্যক্তির পরিচয় যেন শনাক্ত করা সম্ভব না হয়, সে উদ্দেশ্যে খুনিরা লাশ ফেলে দেওয়ার আগে তার মাথা কেটে অন্যত্র লুকিয়ে রাখে। লাশটি বেশি পচে না যাওয়ায় এবং দ্রুত ভেসে ওঠায় পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। কাঁচপুর নৌ–ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) আব্দুল মাবুদ জানান, হত্যাকাণ্ডের এ ঘটনায় স্থানীয় লোকজন তিন জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছিল।
তবে এখনো মাথা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পরিদর্শক মাবুদ আরো বলেন, পানিতে দেহ দ্রুত পচে যায়, প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়। কখনো কখনো মাছের কামড় বা জাহাজের আঘাতে সৃষ্ট ক্ষতের কারণে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ফরেনসিক চিকিত্সকরা বিভ্রান্ত হন। প্রাথমিক তদন্তে হত্যা মনে না হলে লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ সাধারণত অপমৃত্যুর মামলা করে। তদন্তে বা ময়নাতদন্তে হত্যার প্রমাণ পাওয়া গেলে পরে সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়, জানান তারা। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক জানিয়েছেন,অপরাধীরা প্রমাণ নষ্ট করতে ও আইনের চোখ ফাঁকি দিতে হত্যার পর মরদেহ ফেলার জন্য নদী ও রেলপথ বেছে নেয়। তিনি আরো বলেন, অনেক লাশ পাওয়া যায় যেগুলো অনেক বেশি পচে গেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির ঠিকানা থেকে অনেক দূরের এলাকায় মরদেহ ফেলে দেয় অপরাধীরা। কখনো কখনো লাশ ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে যায়, পরে পরিবার খোঁজ পায় না। ফলে লাশ অজ্ঞাত থেকে যায়। পরিবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। ঢাকা জেলা নৌ–পুলিশ সুপার (এসপি) আবদুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, যখন আমরা পরিচয় শনাক্ত করতে পারি না এবং দীর্ঘ সময় পরও মামলার অগ্রগতি হয় না, তখন সদর দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করে অন্য কোনো সংস্থাকে তদন্তের ভার দেওয়া হয় অথবা আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তবে, কেউ মরদেহ শনাক্ত করতে এলে মিলিয়ে দেখার জন্য আমরা ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করে রাখি।