নড়াইল শহরের সড়কগুলোর পাশে প্রায় সময়ই দেখা যায়, কেউ না কেউ গাছের পরিচর্যা করছেন। কেউ ছোট গাছের চারপাশ ঘিরে দিচ্ছেন; পরিষ্কার করছেন আগাছা। তাদের একজন মনির হোসেন, যিনি এলাকাতে ‘যাযাবর মনির’ নামে পরিচিত। গত ৩৪ বছরে শহরের বিভিন্ন এলাকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ১২ হাজার ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করেছেন তিনি। এর মধ্যে বট–পাকুড় গাছ ৬৫টি এবং তালগাছ প্রায় তিন হাজার। নড়াইল শহরের মহিষখোলা এলাকার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মনির হোসেন বলেন, ‘আমার মা গাছপালা খুব পছন্দ করতেন। সুযোগ পেলেই বাড়ির আঙিনায় গাছ রোপণ করতেন। শৈশবেই মাকে হারিয়েছি। কিন্তু তাঁর বৃক্ষপ্রেম আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে।
মায়ের সেই শখ থেকেই ১৯৯১ সাল থেকে আমি গাছ লাগানো শুরু করি। যতদিন বাঁচব ততদিন এভাবে গাছ লাগিয়ে যাব।’ শুধু মনির হোসেন নন, বেশ কয়েক বছর ধরে বৃক্ষরোপণ করে আসছেন নড়াইল শহরের বাসিন্দা খন্দকার আল মুনসুর বিল্লাহ, মুন্সী কামরুজ্জামান বুলবুল, শাহ আলম, নজরুল ইসলাম, অলিউল মাসুদ কোটন, ইমরান, ইমন, আমিনুল হাসান মিঠু। তারা নিজ অর্থায়নে নিজেদের শহর সবুজায়ন করে চলেছেন। রোপণ করেছেন হাজার হাজার গাছ। প্রতিদিন সকালে শাবল, কাচি, বাঁশের লাঠি ও দড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। গবাদিপশু থেকে রক্ষায় খাঁচা দেওয়া, পলিথিন দিয়ে গাছের গোড়া মোড়ানো, পানি দেওয়া সবই করেন তারা। নড়াইল সরকারি বালক ও বালিকা বিদ্যালয়, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, আদালত চত্বর, নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ, নড়াইল ফেরিঘাট, নড়াইল শহরের চার লেন সড়কের দুই পাশে চোখে পড়বে তাদের লাগানো গাছের সারি। এসব গাছের মধ্যে রয়েছে বট–পাকুড়, তাল, আম, জাম, কাঁঠাল, বেল, কাঠবাদাম, আমড়া, জামরুল, আমলকী, অর্জুন, হরীতকী, পলাশ, কদম, বকুল। এই বৃক্ষপ্রেমীরা জানান, তারা প্রথমে তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে শহরে গাছ রোপণ ও পরিচর্যা করেন। এর মধ্যে মনির দীর্ঘ ২৯ বছর একা নিজের মতো করে কাজ করেছেন। পাঁচ বছর আগে থেকে শাহ আলমকে সঙ্গে নেন।
গত বছর থেকে ইমরান ও ইমন তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। মনির বলেন, আমি চাই, সবাই বৃক্ষরোপণের কর্মযজ্ঞে এগিয়ে আসুক। মুনসুর বিল্লাহ, কামরুজ্জামান বুলবুল ও নজরুল ইসলাম একসঙ্গে কাজ করেন। তবে কিছুদিন আগে চাকরির কারণে নজরুল অন্যত্র চলে যাওয়ায় বর্তমানে মুনসুর ও কামরুজ্জামান একসঙ্গে বৃক্ষরোপণ করছেন। শাহ আলম, অলিউল মাসুদ ও আমিনুল হাসান কাজ করেন একসঙ্গে। শাহ আলম মাঝে মাঝে মনিরের সঙ্গেও বৃক্ষরোপণ করেন। পরস্পর বন্ধু খন্দকার আল মুনসুর বিল্লাহ ও মুন্সী কামরুজ্জামান বুলবুল। তারা বলেন, ‘ক্লান্ত পথিক গাছের নিচে আশ্রয় নেবে। গাছে গাছে পাখিরা বসবে, ফল খাবে।
সাধারণ মানুষও ফল পেড়ে খাবে। এ ধরনের স্বপ্ন থেকে সড়কের দুই পাশে প্রায় ২৫ বছর আগে থেকে আমরা গাছ লাগিয়ে যাচ্ছি। এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার গাছ লাগিয়েছি। এর মধ্যে ৪০০ গাছ টিকে আছে।’ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন নড়াইল জেলা শাখার সভাপতি শাহ আলম বলেন, একটি আদর্শ শহরের মোট আয়তনের অন্তত ২০ শতাংশ সবুজ স্থান থাকতে হয়। কিন্তু সে পরিমাণ সবুজ আমাদের শহরে নেই। মানুষ, বন্যপ্রাণী ও পাখির বেঁচে থাকার জন্য গাছ লাগানো জরুরি। সবাইকে এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে। নড়াইলের ফরেস্ট রেঞ্জার কাজী ইশতিয়াক রহমান বলেন, তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হবে। তারা যদি আমাদের কাছ থেকে গাছের চারা নিতে চান, আমরা সেই ব্যবস্থা করব। জেলা প্রশাসক শারমিন আক্তার জাহান বলেন, বৃক্ষপ্রেমীদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে, যাতে তাদের দেখে আরও অনেকে বেশি বেশি গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ হন।