দিনমজুর আবদুল জলিল (ছদ্মনাম) কয়েক বছর আগে আদাবরের বালুর মাঠ এলাকায় ভাড়া নেওয়া জমিতে চার রুমের টিনের ঘর তোলেন। এক রুমে তিনি থাকতেন। বাকি রুম সাবলেট হিসেবে ভাড়া দিতেন। আয় ছিল ৯ হাজার টাকা। এটা ছিল তার অয়ের অন্যতম উত্স। কিন্ত বছর খানেক আগে থেকে কিশোর গ্যাং তার কাছে চাঁদা দাবি শুরু করে। তিনি জানান, প্রায় এক মাস আগে কিশোর গ্যাং গ্রুপের মনির ও গুজা মনিরের লোকজন তার কাছে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা না দিতে চাইলে নির্দয়ভাবে তাকে পেটায়। বলে ১৫ দিনের মধ্যে টাকা না দিলে আবারও মারবে। এ অবস্থায় পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি ঢাকা উদ্যান হাউজিংয়ে ঘর ভাড়া করে চলে যান। শুধু দিনমজুর জলিলই নন। মোহাম্মপুর–আদাবর এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কিশোর গ্যাংকে নিয়মিত চাঁদা দিতে তারা বাধ্য হচ্ছেন, নয়তো হামলার শিকার হতে হয় এবং আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছেন তারা। রাতে মানুষ বাইরে বের হতে সাহস পায় না। গ্যাং সদস্যরা মানুষকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চায়, মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়, এমনকি প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনাও করে।
কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করে না। ভুক্তভোগীরা জানান, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের পোশাক, চুলের স্টাইল বিচিত্র। তাদের চলাফেরা ভীতিকর। তুচ্ছ ঘটনায়ও শক্তি জাহির করতে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলে পড়ে গ্যাংয়ের সদস্যরা। সিনিয়র–জুনিয়র দ্বন্দ্বে মারামারিতে জড়ানো ছাড়াও হরহামেশা নারীদের উত্ত্যক্ত করছে তারা। এ ছাড়া গণছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি–স্থাপনা দখল ও আধিপত্যের রেষারেষিতে প্রায়ই খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে তারা। স্থানীয়রা জানান, চাঁদাবাজির বৈধতা দেখাতে গিয়ে এইসব গ্যাংয়ের সদস্য প্রায়ই বলে, জামিন খরচ মেটাতে টাকা লাগে। আবদুল জলিলকে এমনটাই বলা হয়েছিল। সম্প্রতি কয়েক জন জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে, তাকেও কিছু দিতে হবে। জলিলের মতো অনেকেই বালুর মাঠ এলাকায় ভাড়া নিয়ে সেখানে টিনের ঘর বানিয়ে ভাড়া দেন। মোহাম্মদপুরের এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, তিন বছর আগে তিনি ৩ কোটি টাকায় একটি প্লট কিনেছিলেন। তখনই তাকে একটি গ্যাংকে ১০ লাখ টাকা দিতে হয়েছিল। একই লোকেরা এখন আরেকটি গ্রুপে যোগ দিয়ে আবারও ১০ লাখ টাকা চাইছে। মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকার আরো কয়েক জন সম্পত্তির মালিক ও ব্যবসায়ীও একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তারা বলেন, গ্যাং আর রাজনৈতিক জোটবদলের ফাঁদে পড়ে বারবার তারা চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন।
গ্রেফতার হলেও বেরিয়ে আসে জামিনে :র্যাব–২–এর কমান্ডিং অফিসার খালিদুল হক হাওলাদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকা থেকে ৮৮৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত। আমরা অন্তত ২০টি গ্রুপ শনাক্ত করেছি। এর মধ্যে কবজি কাটা আনোয়ার ও টুন্ডা বাবুর গ্রুপ সবচেয়ে শক্তিশালী। কিছু গ্যাংয়ে ২০–৩০ জন থাকে, আবার কোনোটাতে ৬০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। এদের অনেকে একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছে, কিন্তু জামিনে বেরিয়ে এসে আরো আগ্রাসীভাবে চাঁদাবাজি শুরু করেছে।’ আদালত সূত্র জানায়, এফআইআরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকার কারণে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রায়ই জামিন পেয়ে যায়। এছাড়া যারা কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত তাদের অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি পুলিশও শক্তিশালী প্রমাণ হাজির করতে পারে না।
তবে এ ব্যাপারে আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম জাকারিয়া জানিয়েছেন, ‘আমরা যথাযথভাবে প্রমাণসহ অভিযুক্তদের হাজির করি। কিন্তু কীভাবে তারা জামিন পেয়ে যায় তা আমরা জানি না।’ জানতে চাইলে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ডেপুটি কমিশনার ইবনে মিজান বলেছেন, ‘এই কিশোর গ্যাং সদস্যরা মূলত ভাসমান এবং তাদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই, যার কারণে তাদের খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে আমরা তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনব।’ এদিকে সর্বশেষ গত সোমবার সুনিবিড় হাউজিং এলাকার একটি গ্যারেজে অভিযান চালাতে যান আদাবর থানা পুলিশের কয়েক জন সদস্য। এ সময় স্থানীয় ‘কিশোর গ্যাং’ চক্রের সদস্যরা দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। হামলায় পুলিশ সদস্য আল–আমিন গুরুতর আহত হন। এ ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে ১০২ জনকে আটক করে এবং অস্ত্র ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করে।