খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালে বাঘাইছড়ি পৌরসভার তালুকদার পাড়া ও মারিশ্যা ইউনিয়নের তুলাবান গ্রামে ‘আতর’ তৈরির জন্য দুটি চুল্লি স্থাপন করা হয়েছিলো। তালুকদার পাড়া গ্রামের চুল্লিতে ছয়টি ও তুলাবান গ্রামের চুল্লিতে তিনটি পাত্র বসানোর জায়গা রয়েছে। সারা বছর কাঁচামাল সংগ্রহ করা গেলে চুল্লী দু’টি থেকে তিন কোটি টাকার বাণিজ্যিক ‘আতর’ তৈরি করা সম্ভব হবে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে চুল্লী দু’টি বছরে ৮ থেকে ৯মাস চালু থাকে। বর্তমানে চুল্লী দু’টি থেকে বছরে অন্তত দুই কোটি টাকার বাণিজ্যিক ‘আতর’ তৈরি করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের সাথে বলে জানা গেছে, বর্তমানে যেসব জায়গায় আগরবাগান রয়েছে, সেগুলোর গাছ পরিপক্ব হতে আরও পাঁচ থেকে ছয় বছর সময় লাগবে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া বেশির ভাগ সুগন্ধিযুক্ত আগরগাছ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে নেওয়া হচ্ছে। সেখানে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুগন্ধি বের করে বিদেশে নেওয়া হয়। বাঘাইছড়ি উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অনন্ত চাকমা বলেন, আমার বাগানের ৩৬টি আগরগাছ ১৩ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গাছটির মূল্য ৬ লাখ টাকা।
অন্য গাছগুলো ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। আমাদের গ্রামে অনেকে আগরগাছ বিক্রি করছেন। খেদারমারা ইউনিয়নের ঢেবাছড়ি গ্রামের আলোময় চাকমা বলেন, তিনি তিনটি আগরগাছ ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা দিয়ে বিক্রি করেছেন। স্থানীয় ‘আতর’ ব্যবসায়ী সন্তোষ প্রিয় চাকমা বলেন, আমাদের আতর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নেওয়া হচ্ছে। আমরা এখন পর্যন্ত আগরগাছ থেকে প্রাকৃতিকভাবে ও পেরেক ঢুকিয়ে তৈরি হওয়া সুগন্ধি সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের দিচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঘাইছড়ি উপজেলায় সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিকভাবে আগরের সুগন্ধি পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া খাগড়াছড়ির পানছড়ি ও দীঘিনালা উপজেলায় কিছু পাওয়া যায়। এ ব্যবসায়ী আরও বলেন, আমরা ২০২৩ সালে একটি সমিতি করেছি। সেটি রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সমিতিটি রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে কয়টা গাছ বিক্রি করা হলো, কত টাকার ব্যবসা হলো, লাভ–ক্ষতি এসবের হিসাব থাকবে।
এখন ব্যক্তি উদ্যোগে বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে আগরগাছ বিক্রি হচ্ছে। তাই সঠিক হিসাব কেউ দিতে পারবেন না। বাঘাইছড়ি উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের বাঘাইছড়ি, উগলছড়ি, তালুকদার পাড়া, মহিষপয্যা, শিজক, তুলাবানসহ ১০ থেকে ১২টি গ্রামে ও খেদারমারা ইউনিয়নে শিলকাটাছড়া, ঢেবাছড়ি, নলবনিয়া, উলুছড়িসহ ৮ থেকে ১০টি গ্রামে প্রাকৃতিকভাবে সুগন্ধি পাওয়া যাচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া সুগন্ধির তুলনায় পেরেক দেওয়া সুগন্ধির মান ও দাম অনেক কম। পেরেক ঢুকিয়ে পাওয়া সুগন্ধি প্রতি তোলা ছয় হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্য দিকে যেসব আগরগাছে প্রাকৃতিকভাবে এবং পেরেক ঢুকিয়েও সুগন্ধি পাওয়া যায়নি, সেসব গাছের কাঠের নির্যাস থেকে সুগন্ধি বের করা হয়। তবে এর মান সবচেয়ে কম। রাঙামাটি বন বিভাগ জানিয়েছে, নব্বইয়ের দশকের পর বাঘাইছড়ি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পরীক্ষামূলক বাগান ও বিভিন্ন বাড়ির আঙিনায় আগরগাছ রোপণ করা হয়েছিলো।
১৯৯৬ সালে উপজেলার বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের কাচালং আর্যপুর বনবিহারে দুই একর জমিতে সাড়ে তিন হাজার আগর চারা রোপণ করা হয়েছিলো। ২০১৭ সালে সিলেটের কিছু ব্যবসায়ী এসে বন বিহার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগর গাছ ক্রয়ের অনুরোধ জানালে বিহার কর্তৃপক্ষ প্রতিটি আগর গাছ ১৯হাজার টাকা করে ৩০০টি গাছ মোট ৫৭লাখ টাকায় বিক্রি করেছিলেন। ব্যবসায়ীরা অন্য গ্রাম থেকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে দুই শতাধিক আগরগাছ সংগ্রহ করেছিলেন। এসব আগরগাছে প্রাকৃতিক ভাবে হওয়া পর্যাপ্ত সুগন্ধি ছিল। বর্তমানে বাঘাইছড়িতে ব্যক্তি মালিকানাধীন অন্তত ১৫লাখ আগরগাছ আছে বলে ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকেরা জানিয়েছেন। রাঙামাটি সার্কেলের দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস. এম. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ২০০৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ৫০০ একর জমিতে আগর চাষ করেছে বন বিভাগ। এখনো সুগন্ধি হয়েছে কি না, দেখা হয়নি। তবে পরিপক্ব কিংবা সুগন্ধি হতে গাছের বয়স কমপক্ষে ২০ বছর হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিকভাবে হওয়া আগরগাছের সুগন্ধির চাহিদা মধ্যপ্রাচ্যে বেশ রয়েছে বলে যোগ করেন।