জুলাই গণ–অভ্যুত্থান দমনে কারা কিভাবে নিষ্ঠুর ভূমিকা রেখেছিল, কারা ছিলেন গুলির নির্দেশদাতা–এ রকম বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য জবাবন্দির খণ্ডিত অংশ হিসাবে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। রাতের ভোটের আসল কারিগর ছিলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারী। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভোট শুরু হওয়ার আগের রাতে ৫০ ভাগ ভোট ব্যালট বাক্সে ভরে রাখতে তিনিই পুলিশকে নির্দেশ দেন। এর আগে এভাবে ভোট করার জন্য তিনিই প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পরামর্শ সমর্থন করে অ্যাকশান প্ল্যান বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে সবিস্তারে তথ্য দিয়েছেন কারাবন্দি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন। গত ২৪ মার্চ তিনি আদালতে এ জবানবন্দি দেন। সম্প্রতি বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এদিকে এসব অপকর্মের পুরস্কার হিসাবে আইজি পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর জাবেদ পাটোয়ারীকে আওয়ামী লীগ সরকার সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূত হিসাবে দুই দফায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়। ৫ আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত তিনি সেখানে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি বিদেশে পলাতক আছেন।
যেভাবে ভূমিকা রাখেন রাতের ভোটে : ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গ তুলে ধরে আবদুল্লাহ আল–মামুন জবানবন্দিতে বলেন, ওই সময় তিনি ঢাকার রেঞ্জ ডিআইজি ছিলেন। তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রায় ৫০% ব্যালট (নৌকায় সিল দিতে) রাতের বেলায় বাক্সে ভরে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন মর্মে শুনেছি। এরপর মাঠ পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে ওই বিষয়ে রাতে ব্যালট বাক্সে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়। রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতায় জেলা প্রশাসন, ডিসি, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, এসপি ও থানার ওসিরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে পুলিশের বিপিএম ও পিপিএম পদক দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচনসহ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সক্রিয় পুলিশ অফিসারদের বিবেচনা করা হতো। এক্ষেত্রে সঠিকভাবে পেশাদারত্বকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
পুলিশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ : ২০১৮ সালের পর পুলিশ বাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাব আরও বেশি বৃদ্ধি পায়। কতিপয় পুলিশ অফিসার প্রভাবশালী হিসাবে স্বীকৃতি পান। তাদের সংশ্লিষ্ট পদস্থ কর্মকর্তারা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখতেন না। তাদের নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় রাতের বেলা নিয়মিত বৈঠক হতো। যা গভীর রাত পর্যন্ত চলত। মন্ত্রীর বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান হারুন–অর রশীদ, ডিআইজি নুরুল ইসলাম, এডিশনাল ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকার, এডিশনাল এসপি কাফি, ওসি মাজাহার, ফরমান ও অপূর্ব হাসানসহ বেশ কিছু অফিসারের। এরা কেউই আইজিপির নির্দেশ সঠিকভাবে মানতেন না। এসব কর্মকর্তা নিজেদেরকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বলে মনে করতেন। তাদের কারও কারও সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ রাজনৈতিক সিনিয়র নেতাদের ভালো সম্পর্ক ছিল। প্রভাব বিস্তার প্রসঙ্গে তিনি জবানবন্দিতে বলেন, পুলিশে গোপালগঞ্জ জেলার অবস্থান বেশ শক্ত এবং অফিসার ও ওসি পর্যায়ে গোপালগঞ্জ জেলার প্রাধান্য ছিল। তারা সাধারণত কমান্ড মানতেন না। নিজেদের ইচ্ছামত কাজ করতেন। এদের বিষয় সাধারণত দেখতেন অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম ও পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
ঢাকার বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে গোপালগঞ্জ জেলার পুলিশ অফিসার ছিলেন। পুলিশের মধ্যে মনিরুল ইসলাম ও কমিশনার হাবিবের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। তারা আলাদাভাবে তাদের লোকজন ও সমমনা পুলিশ অফিসারদের মেইনটেন করতেন। পুলিশ বাহিনীর ইমেজ রক্ষা এবং বাহিনীতে সৃষ্ট নেতৃত্বের এই দ্বন্দ্বকে প্রশমিত করার লক্ষ্যে তাকে (আবদুল্লাহ আল–মামুন) আইজিপি হিসাবে নিয়োগ ও পরবর্তীতে দুবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা হয়।
র্যাব নিয়ন্ত্রণ করতেন তারিক সিদ্দিকি : জবানবন্দিতে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, র্যাব কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা, গুম করার নির্দেশনা বা ক্রসফায়ারের সিরিয়াস নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত বলে শুনেছি। কিছু কিছু নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকির পক্ষ থেকেও আসত বলে তিনি জানতে পারেন। র্যাব যদিও পুলিশের আইজির আওতাধীন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চেইন অব কমান্ড মানা হতো না এবং র্যাব এর প্রধানগণ আইজিপিকে উপেক্ষা করেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশে কাজ করতেন। টিএফআই সেলে কতজন বন্দি আসত সেসব বিষয় তাকে জানানো হতো না। জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, ‘র্যাবের মহাপরিচালক থাকার কারণে তিনি জানতেন টিএফআই সেল র্যাবের সদর দপ্তরের অধীনে পরিচালিত হতো। এটির অবস্থান উত্তরায় র্যাব–১ এর কম্পাউন্ডের ভেতরে।
এছাড়া র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটের অধীনেও আলাদা আলাদা সেল বা বন্দিশালা ছিল। যেগুলো সংশ্লিষ্ট র্যাব ইউনিটগুলোর প্রধানদের অধীনে পরিচালিত হতো। র্যাব কর্তৃক রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা কোনো ব্যক্তিকে তুলে আনা, জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন এবং গোপন বন্দিশালায় আটক রাখার বিষয়টি র্যাবের ভিতরে একটা কালচার হিসেবে বিবেচিত হতো। তবে এই কাজগুলো প্রধানত র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকগণ সমন্বয় করতেন। তিনি র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রসঙ্গত, কারাবন্দি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছেন। যে মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালসহ তিনিও আসামি।