পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীদের মধ্যে প্রথম অবস্থানে আছে মশা। এটিই একমাত্র প্রাণী, যেটি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটায়। প্রতিবছর পৃথিবীতে সাড়ে সাত লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় মশা। মশাবাহিত রোগ অনেক। এর মধ্যে চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, জিকা, ইয়েলো ফিভার, ওয়েস্টনাইল ফিভার অন্যতম। সাম্প্রতিককালে ডেঙ্গু–চিকুনগুনিয়া ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হুঁশিয়ার করেছে, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু–চিকুনগুনিয়া ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশেও গত কয়েক বছর ডেঙ্গু–চিকুনগুনিয়ার ভয়ংকর রূপ দেখা যাচ্ছে।
তবে এ বছর চট্টগ্রামে এক বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ওই অঞ্চলে জ্বরে আক্রান্ত রোগীর কমবেশি ৮০ শতাংশই চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত হচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে জ্বর নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে ৮৯ শতাংশ পর্যন্ত রোগীর দেহে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে, যা এই রোগের ভয়াবহতা ও বিস্তারের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। নগরীর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এপিক হেলথ কেয়ারে ৩৫৬ রোগীর মধ্যে ৩১৬ জন (প্রায় ৮৯%) চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন। পার্কভিউ হাসপাতালে ২৬৩ রোগীর মধ্যে ১৪২ জনের (প্রায় ৭৪%) পরীক্ষায় এই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, চট্টগ্রামে জ্বর নিয়ে আসা প্রত্যেক রোগীই এখন কার্যত চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। সরকারি পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা না থাকায় প্রকৃত সংক্রমণের মাত্রা ও বিস্তৃতি এখনও বোঝা যাচ্ছে না। দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ধরা পড়ে ২০০৮ সালে রাজশাহীর পবা উপজেলায়, যেখানে ৩২ জন আক্রান্ত হন। এরপর ২০০৯ সালে পাবনার আটঘরিয়া (সাঁথিয়া) এবং ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে রোগটি পুনরায় দেখা যায়।
তবে ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাব ঘটে ঢাকা শহর এবং আশপাশের এলাকায়। এ সময় লক্ষাধিক মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলেও সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান অনুপস্থিত। চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ দ্রুত বাড়লেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগ নির্ণয়ের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়নি। রোগ শনাক্তকরণ পুরোপুরি নির্ভর করছে বেসরকারি ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর ওপর। এসব কেন্দ্রে রোগ নির্ণয়ে খরচ চার হাজার থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত হয়, যা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বড় চাপ। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই পরীক্ষা না করিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন শুধু উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে। রোগ শনাক্ত না হলে সংক্রমণ ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।
চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়লেও এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। রোগটি সরকারের নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে অন্তর্ভুক্ত না থাকায় সংক্রমণ পরিস্থিতির কোনো আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে রোগটির প্রকৃত বিস্তার ও গতিপ্রকৃতি বুঝে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন। এ অবস্থায় স্থানীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুধু সচেতনতামূলক পোস্টার ও লিফলেট বিতরণে সীমাবদ্ধ থেকেছে, যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। রোগ শনাক্তকরণ ও প্রতিবেদন বাধ্যতামূলক না হলে চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
এখন প্রয়োজন সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা; যেখানে মশক নিধন, জনসচেতনতা, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা একযোগে চালু থাকবে। চিকুনগুনিয়ার বর্তমান বিস্তারে কীটতত্ত্বগত দিক থেকেও চট্টগ্রাম শহর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের বেশ কিছু ওয়ার্ডে এডিস মশার প্রজনন হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনসেক্টারিয়ারিং অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশনের গবেষণা অনুযায়ী চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের ইনডেক্স (BI) পাওয়া গেছে ২৫ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৭৫ পর্যন্ত, যেখানে ২০–এর ওপরে মানেই এডিস মশাবাহিত রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি নির্দেশক।
আরেক জরিপে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের এসব এলাকায় ৭০ শতাংশ মশাই এডিস এজিপ্টাই প্রজাতির, যা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকার মতো ভাইরাসজনিত রোগ ছড়াতে সক্ষম। এ পরিস্থিতিতে সংক্রমণ রোধে জরুরি ভিত্তিতে মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করা এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করে লার্ভার জন্মস্থান ধ্বংসে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক নেই। তাই সংক্রমণ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হলো মশার বিস্তার রোধ এবং ব্যক্তিগত সতর্কতা গ্রহণ। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলা কামড়ায় এবং পরিষ্কার জমে থাকা পানিতে প্রজনন করে। তাই প্রথম করণীয় হলো ঘরবাড়ি ও আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা, যে কোনো পাত্রে পানি জমে থাকলে তা নিয়মিত ফেলে দেওয়া। ফুলদানি, কুলার, টায়ার বা ড্রামজাতীয় জায়গাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা। চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহন করে এডিস এজিপ্টা ও এডিস এলবোপিকটাস প্রজাতির মশা। এডিস এজিপ্টা স্বভাবগতভাবে গৃহপালিত ও নগরকেন্দ্রিক।
এটি আমাদের শহরে ঘরের ভেতরে এবং এর কাছাকাছি থাকে। এ জন্য এটিকে আমরা গৃহপালিত মশা বলে থাকি। এডিস এজিপ্টা মশা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া বিস্তারে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভূমিকা রাখে। আরেকটি প্রজাতি এডিস এলবোপিকটাস, যাকে এশিয়ান টাইগার মশা বলা হয়। এটি বন্য, জংলি বা গ্রামের মশা। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে মশাটি রয়েছে। এই প্রজাতি ডেঙ্গু বিস্তারে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। এই মশা বিভিন্ন পাত্র ছাড়াও গাছগাছালি যুক্ত এলাকায় গাছের কোটর, কলাগাছের দুই পাতার মাঝখানে, কচুপাতার মাঝখানে, কাটা বাঁশের গোড়ায় জমে থাকা পানিতে জন্মায়। নগরে এডিস এজিপ্টা মশা জন্মানোর জন্য অন্যতম স্থান হলো ড্রাম, টায়ার, বালতি, যে কোনো ধরনের মাটির পাত্র, নির্মাণাধীন ভবনের লিফটের গর্ত, টাইলস ভেজানোর চৌবাচ্চা, কিউরিংয়ের পানি জমার স্থান, বিশেষ করে বেজমেন্ট। চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ও জিকা ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে, তাই এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তিনটি রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অন্যান্য মশার তুলনায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণও সহজ, কারণ এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে বংশবিস্তার করে। জমা পানির পাত্র অপসারণ কঠিন কোনো কাজ নয়।
অন্যান্য মশার চেয়ে এডিস মশা কীটনাশক সহনশীল। তাই কীটনাশক দিয়েও এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। ব্যক্তিগতভাবে মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে দিনের বেলাতেও মশারি ব্যবহার করা, শরীর ঢেকে রাখে এমন কাপড় পরা এবং মশা প্রতিরোধী ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করা উচিত। বাড়ি ও কর্মস্থলে দরজা–জানালায় জাল ব্যবহার করা এবং মশানিধনের জন্য প্রয়োজনে অ্যারোসল বা ধোঁয়া ব্যবহার করা যেতে পারে। স্থানীয় প্রশাসনের উচিত মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করা, বিশেষ করে উচ্চ সংক্রমণের এলাকাগুলোতে ফগিং ও লার্ভিসাইড ছিটানো কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালনা করা। পাশাপাশি গণসচেতনতা বাড়ানোর জন্য স্কুল, মসজিদ ও কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে প্রচার অভিযান চালানো প্রয়োজন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সকল কার্যক্রমে জনগণকে সম্পৃক্ত করা, যাতে তারা নিজেরাই মশার উৎস ধ্বংসে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। সমন্বিতভাবে এগিয়ে এলে চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ ভয়াবহ পর্যায়ে চলছে। সেখানে দ্রুত সরকারি পর্যায়ে রোগ নির্ণয় ব্যবস্থার বাস্তবায়ন, সাশ্রয়ী পরীক্ষার ব্যবস্থা এবং তাৎক্ষণিক মশা দমন ও সচেতনতা কার্যক্রম প্রয়োজন। উপসর্গ যথাযথভাবে নির্ণয় ও চিকিৎসার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।