ওরা কারা। কী তাদের পরিচয়। তারা কী পেশাদার খুনি, নাকি রাজনৈতিক কর্মী। না পতিত স্বৈরাচারের দোসর। আলোচিত ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনীতির মাঠে দাবার ঘুঁটি হয়ে ওঠা ঘাতকদের নিয়ে এমন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে চারদিকে। ইতোমধ্যে নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে তাদের একেক পরিচয়। তবে ঘাতকদের প্রকৃত পরিচয় এখনো ধোঁয়াশাচ্ছন্ন এবং তারা এখন পর্যন্ত অধরা। স্থানীয়দের কেউ কেউ বলছেন, ঘাতকদের অনেকে যুবলীগের রাজনীতি করতেন। সরকার পতনের পর ভোল পালটে অন্য দলে যোগ দেন। ইতোমধ্যে ঘাতকদের নাম জড়িয়ে ফেসবুকে পালটাপালটি পোস্ট দিচ্ছেন অনেকে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে–রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক ঘাতকদের কেউই ছাড় পাবে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও ইতোমধ্যে বিচারের দাবি জানানো হয়েছে। এদিকে ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও চিত্র নিয়ে নানা ধরনের সন্দেহ এবং সংশয় দানা বাঁধছে।
বিশেষ করে খুব কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডের এমন নিখুঁত ভিডিও চিত্র কিভাবে ধারণ করা সম্ভব হলো এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পরপরই বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, সভা–সমাবেশের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে মাঠ গরম করা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের জন্যই এ ঘটনা পরিকল্পিত কিনা এমন কথাও বলছেন অনেকে। নাকি এর নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনো ষড়যন্ত্রের নীল নকশা।
ভিডিও : ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, সোহাগের রক্তাক্ত নিথর দেহের ওপর একের পর এক পাথর দিয়ে আঘাত করছেন কয়েক যুবক। এদের মধ্যে স্পষ্টভাবে অন্তত তিনজনের চেহারা ধরা পড়ে। টানা কয়েক মিনিটের ভিডিও চিত্রে তিন ঘাতক ছাড়া আরও বেশ কয়েকজনকে হত্যাকাণ্ডে অংশ নিতে দেখা যায়। এ সময় আশপাশে আরও কয়েকশ মানুষ উপস্থিত থাকলেও তারা ছিলেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। ভিডিও চিত্রে ধরা পড়া তিন ঘাতকের একজনের পরনে নীল গেঞ্জি–প্যান্ট, একজন আকাশি শার্ট ও জিন্স প্যান্ট এবং আরেকজন কালো গেঞ্জি ও প্যান্ট পরে ছিলেন। রোববার পুলিশ এবং স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে ঘাকতদের পরিচয় সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য পাওয়া যায়। স্থানীয়দের কয়েকজনকে তাদের ছবি দেখানো হলে তারা জানান, পাথর দিয়ে সোহাগের দেহে আঘাত করা নীল গেঞ্জি পরিচিত যুবকের নাম রুহুল আমিন। তার বাড়ি কেরানীগঞ্জে। এছাড়া কালো গেঞ্জি পরিহিত যুবকের নাম মনির ওরফে লম্বা মনির। এদের দুজনেই স্থানীয় সন্ত্রাসী হিসাবে পরিচিত। স্থানীয়রা জানান, কোনো পদ–পদবি না থাকলেও তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে চলে। এর বাইরে আকাশি শার্ট পরিহিত অপর ঘাতক মিটফোর্ড হাসপাতালকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের সদস্য। তার নাম জানা যায়নি। তিনি নিজেও পেশায় অ্যাম্বুলেন্স চালক। তবে হত্যাকাণ্ডে তার অংশগ্রহণ তাৎক্ষণিক নাকি পরিকল্পিত সে সম্পর্কে স্থানীয়রা কেউ নিশ্চিত নন। মিটফোর্ড এলাকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, সোহাগ হত্যায় অংশ নেওয়া ঘাতকদের অনেকেই আগে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আগস্টে সরকার পতনের পরপরই তারা ভোল পালটান।
নতুন করে রাজনৈতিক পরিচয় দিতে শুরু করেন তারা। এমনকি এদের কেউ কেউ স্থানীয় যুবদলের নেতাদের সঙ্গেও ওঠাবসা শুরু করেন। রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও দেখা যায় এদের কয়েকজনকে। স্থানীয়রা বলছেন, চক্রের সদস্যরা সরকারি বিদ্যুৎ এবং টেলিফোন লাইনের তার চুরি করে ভাঙারি হিসাবে বিক্রি করে দেয়। এ ব্যবসার সঙ্গে রাজধানীর মহল্লাভিত্তিক চোরাকারবারিদেরও যোগসাজশ রয়েছে। এ কারণে ভাঙারি ব্যবসা সাধারণ মনে হলেও বাস্তবে এ খাতে বড় অঙ্কের লেনদেন হয়। বিশেষ করে ইস্পাত, তামা এবং অ্যালুমিনিয়ামসহ নানা ধরনের মূল্যবান চোরাই ধাতু বিক্রি থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আসে। এ কারণে ভাঙারি ব্যবসা ঘিরে গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক সিন্ডিকেট। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তাদের চাঁদা দিয়েই ব্যবসা করতে হয়। আগস্টে সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পলিয়ে গেলে স্থানীয় প্রভাবশালীদের অনেকেই সুযোগ নেন। পুলিশ জানায়, সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন। সেখানে ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত হিসাবে মাহমুদুল হাসান মহিন, সারোয়ার হোসেন টিটু, মনির ওরফে ছোট মনির, আলমগীর, মনির ওরফে লম্বা মনির, নান্নু, সজীব, রিয়াদ, টিটন গাজী, রাকিব, সাবা করিম লাকী, কালু ওরফে স্বেচ্ছাসেবক কালু, রজব আলী পিন্টু, মো. সিরাজুল ইসলাম, রবিন, মিজান, অপু দাস, হিম্মত আলী, আনিসুর রহমান হাওলাদারসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এদের প্রত্যেককে গ্রেফতারে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে পাথর হাতে নৃশংসতা চালানো তিন যুবককে ধরতে পুলিশ ও র্যাবের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। নিহতের ভাগনি মীম আক্তার জানান, তার মামার পরিচিত লোকজনই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তার মামা স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং মিটফোর্ড এলাকায় ব্যবসা করতেন। কিন্তু টিটু, মহিনসহ স্থানীয় আরও কয়েকজন এই ব্যবসায় ভাগ বসাতে চাচ্ছিল। ব্যবসার ৫০ শতাংশ অংশীদার দাবি করেছিল তারা। কিন্তু ভাগ না পেয়ে তারা মামাকে নির্মমভাবে খুন করে। আদালত সূত্র জানায়, সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা হলেন–মাহমুদুল হাসান মহিন, তারেক রহমান ওরফে রবিন, আলমগীর, মনির ওরফে লম্বা মনির, টিটন গাজী, সজিব ও রাজিব ব্যাপারী। এদের মধ্যে রবিন অস্ত্র মামলায় দায় স্বীকার করে শনিবার আদালতে জবানবন্দি দেন। রোববার আলমগীর ও মনির ওরফে লম্বা মনিরকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
ভিডিও নিয়ে রহস্য : এ ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিও চিত্র নিয়ে নানা ধরনের সংশয় দানা বাঁধছে। বিশেষ করে হত্যাকাণ্ডের খুব কাছ থেকে ভিডিও ধারণ এবং দ্রুততম সময়ে তা ছড়িয়ে দেওয়ায় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন ছড়িয়ে পড়া ভিডিও চিত্রের উৎস খোঁজ করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হতে পারে। তখন হয়তো এমন নৃশংস ঘটনার আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিটফোর্ড এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময় খুব কাছ থেকে একটি ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এত কাছ থেকে কিভাবে ভিডিও করা সম্ভব হলো। কারণ নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের সময় আশপাশের সবাই ছিলেন ভীতসন্ত্রস্ত। তবে তদন্তসংশ্লিষ্টদের অবশ্য ভিন্নমত। পুলিশের দাবি, ছড়িয়ে পড়া ভিডিও চিত্রের বেশির ভাগই ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত। এছাড়া হত্যাকাণ্ড ঘটেছে প্রকাশ্য রাস্তায়। এ সময় প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ ভিডিও ধারণ করেন। ভিডিও চিত্রে স্পষ্টভাবে চেহারা দেখা গেলেও ঘাতকরা গ্রেফতার না হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার নাসিরুল ইসলাম বলেন, ভিডিও চিত্রে কয়েকজনকে পাথর দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করতে দেখা যায়।
এদের মধ্যে নীল গেঞ্জি এবং আকাশি শার্ট পরিহিত দুই যুবককে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে ডিবির একাধিক টিম কাজ করছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় বুধবার (৯ জুলাই) সন্ধ্যায় চাঁদ মিয়া ওরফে সোহাগ নামে এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে ও পাথর দিয়ে থ্যাঁতলে হত্যা করা হয়। এরপর তার নিথর দেহ সড়কে ফেলে নৃশংস কায়দায় ঘাতকরা উল্লাসে মাতে। পরে এ ঘটনার ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এরপর দৃশ্যমান হয় পুলিশের তৎপরতা।