বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি অবদান রাখা এই শিল্প খাত এখন কঠিন সময় পার করছে। এক সংকট কাটতে না কাটতে আরেক সংকটের মুখে পড়ছে। এ খাত এখন পড়েছে টানাটানির মধ্যে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প সরকারের বাড়তি শুল্ক আরোপের চিন্তা এবং পণ্যের দাম কমাতে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপ, অন্যদিকে স্থানীয় নানা সমস্যা। গত দুই সপ্তাহ ধরে কারখানাগুলোতে গ্যাস নেই বললেই চলে। উদ্যোক্তারা বলছেন, ট্রাম্প সরকার বাড়তি শুল্ক তিন মাস স্থগিত করায় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক কারখানায় অর্ডার বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এতে ক্রেতাদের সঙ্গে নতুন ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছেন কারখানা মালিকরা। জানা গেছে, আপাতত শুল্ক না বাড়লেও আমেরিকার ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কোনো কারখানা থেকে ১০ বা এর চেয়েও বেশি শতাংশ কম দামে পণ্য নিতে চায়। এমনকি আগের অর্ডার দেওয়া পণ্যের দামেও কম দিতে চাপ সৃষ্টি করছে। কেউ কেউ অর্ডার স্থগিত করছে, বাতিলও করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুল্ক নিয়ে টানাটানির কারণে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের দাম ঠিক করতে পারছে না। তারা কম দামে কিনতে চায়। কারণ নিয়ম অনুযায়ী বাড়তি শুল্ক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে দিতে হয়। এই বাড়তি শুল্ক তারা না দিয়ে বাংলাদেশি কারখানা মালিকদের ওপর চাপাতে চাচ্ছে। নতুন এই সংকটকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বলে আখ্যায়িত করছেন উদ্যোক্তারা। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে পাশর্^বর্তী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের কপালে হতাশার ভাঁজ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন উদ্যাক্তা জানিয়েছেন, শুল্ক বাড়বে এই অজুহাতে তারা রীতিমতো দরকষাকষিতে নেমেছে। তারা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ওপরই বাড়তি শুল্ক চাপাতে চাচ্ছে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, বেশকিছু পণ্যের রপ্তানি কমেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ট্রাউজার, টি–শার্ট ও নিট শার্ট, সোয়েটার, শার্ট ও ব্লাউজ এবং অন্তর্বাস। মূলত ট্রাউজার, টি–শার্ট ও সোয়েটারই বেশি রপ্তানি হয়। গত দুই অর্থবছর (২০২২–২৩ ও ২০২৩–২৪) ধরে এই পাঁচ শ্রেণির পোশাকের রপ্তানি কমছে। এখান থেকে বোঝা যায় পোশাকের সার্বিক রপ্তানিও কমছে। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্র বলছে, বাংলাদেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির আয় প্রায় ৮১ শতাংশই আসে ট্রাউজার, টি–শার্ট ও নিট শার্ট, সোয়েটার, শার্ট ও ব্লাউজ এবং অন্তর্বাস থেকে।
এদিকে শীর্ষ তিনটি পোশাক পণ্যের রপ্তানি কমে যাওয়া নিয়ে রপ্তানিকারকরা বলছেন, দুই বছর ধরে সামগ্রিকভাবে তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমেছে। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হওয়া পোশাকের রপ্তানি কমেছে। এসব পণ্যের ক্রয়াদেশ পেতে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হয়। বিভিন্ন কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ট্রাউজার, টি–শার্ট ও সোয়েটারের মতো পোশাকের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমছে। যে কারণে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ক্রয়াদেশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এ বিষয়ে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প এখন কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এক সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আরেক সংকট হাজির। এভাবে ব্যবসা করা যায় না। আন্তর্জাতিক সমস্যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমস্যা নতুন করে যুক্ত হয়েছে। গ্যাসের অভাবে অনেক কারখানা প্রায় বন্ধ। উৎপাদন করতে পারছে না। এর প্রভাব পড়বে সার্বিক রপ্তানির ওপর। এ ছাড়া উৎপাদন ব্যাহত হলে ক্রেতাদের কাছে কমিটমেন্ট রক্ষা করা যায় না। এতে ক্রেতা ছুটে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। মনে হচ্ছে, এ খাতের ওপর যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ পড়েছে। অন্যদিকে বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি ও টিম গ্রুপের এমডি আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, বাংলাদেশের পোশাক খাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তাতে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ক্রেতারা যেখানে কম দাম পাবে সেখান থেকেই পণ্য কিনবে। আমরা যদি অন্যদের তুলনায় কম দামে পণ্য দিতে পারি তাহলে তারা আমাদের কাছ থেকে নেবে, নইলে অন্য দেশ থেকে নেবে। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে টিকে থাকতে হলে অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো সমাধান করা জরুরি।
এদিকে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, পোশাকশিল্পের ওপর কালো মেঘ জমেছে। একটার পর একটা বিপদ যেন ছাড়ছেই না। গ্যাস সংকটে কারখানাগুলো বন্ধের পথে। প্রতি দিন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে ক্রেতাদের চাপ নিয়ে উদ্যোক্তারা এখন দিশাহারা। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য থেকে বছরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি শুল্ক আদায় করে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে মার্কিন পণ্য থেকে বাংলাদেশ প্রায় ১৮০ মিলিয়ন ডলার শুল্ক পায়। সিপিডি বলছে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির ওপর গড়ে ছয় দশমিক দুই শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। তবে বিভিন্ন ছাড় বিবেচনায় নেওয়া হলে গড় শুল্ক দুই দশমিক দুই শতাংশে নেমে আসে। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন আমদানির গড় শুল্ক ১৫ দশমিক এক শতাংশ। সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে ‘ট্রাম্প রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ অ্যান্ড বাংলাদেশ: ইমপ্লিকেশনস অ্যান্ড রেসপন্স’ শীর্ষক সংলাপে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশি পোশাক আমদানি থেকে যুক্তরাষ্ট্র এক বিলিয়নের বেশি শুল্ক পেয়ে থাকে। সিপিডি পরামর্শ দিয়েছে, বাংলাদেশের উচিত রপ্তানি প্রতিযোগিতায় মার্কিন শুল্কের প্রভাব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। বিশেষ করে ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর ব্যাপারে পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তির (টিকফা) মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততাসহ কৌশলগত বিকল্প খুঁজে বের করারও সুপারিশ করেছে।
পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে রপ্তানি ক্ষেত্রে যেসব পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত বা হ্রাস সুবিধা পেতে চায়, তার একটি তালিকা চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যদি নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক ছাড় দেয়, তবে মোস্ট ফেভারড নেশন (এমএফএন) নীতির আওতায় সব বাণিজ্য অংশীদারের মতো একই সুবিধা দিতে বাধ্য হবে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এ ধরনের উদ্বেগের সমাধান করতে পারে বলে জানায় সিপিডি। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানির জন্য বিশেষ অয়্যারহাউজ সুবিধা দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করতে পারে। এটি মার্কিন তুলা দিয়ে তৈরি পোশাকের শুল্ক মওকুফের বিষয়ে আলোচনার সুবিধার্থে হতে পারে বলেও সিপিডির মত।
এদিকে মার্কিন তুলা আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ও বাংলাদেশি পণ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আরোপ করা ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক স্থায়ীভাবে প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কটন কাউন্সিলের (এনসিসিএ) সহায়তা চেয়েছে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কটন কাউন্সিলের (এনসিসি) প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) গ্যারি অ্যাডামসকে লেখা চিঠিতে এই সহযোগিতা চেয়েছেন বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ। একই চিঠি ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাউন্সেলর এরিক গ্লেনকে দিয়েছেন তিনি, এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ এপ্রিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন। ৯ এপ্রিল সিদ্ধান্তটি কার্যকর হওয়ার দিনে তা পরবর্তী তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন ট্রাম্প। তবে সব দেশের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ২৬ শতাংশ শুল্ক বসবে। এই ৯০ দিনের সময় কৌশলগত কূটনীতি ও আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিটিএমএ সভাপতি।
চিঠিতে বলা হয়, বিটিএমএ বাংলাদেশের ১ হাজার ৮৫৬ বস্ত্রকলের প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে সুতা ও কাপড় উৎপাদন, ডাইং, প্রিন্টিং ও ফিনিশিং কার্যক্রম চলে। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। বিটিএমএর সভাপতি বলেন, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৭ কোটি ডলার মূল্যের তুলা আমদানি করেছে বাংলাদেশ। গত বছর বিভিন্ন দেশ থেকে যত সুতা আমদানি করেছে, তার ১২ শতাংশই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সুতা আমদানির পরিমাণ চার থেকে পাঁচগুণ বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে বলে আমরা মনে করি।