গাড়ির নির্গত কালো ধোঁয়ায় মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে এলাকার পরিবেশ। যার প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। এসব দূষিত ধোঁয়া মানুষের শ্বাস–প্রশ্বাসের সঙ্গে মিশে দেহের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। ফলে একজিমা, হাঁপানি, আমাশয় এবং ম্যালেরিয়াসহ নানান রোগে ভুগছে মানুষ। পরিবহন চালকরা বলছেন, গাড়িতে যদি সমস্যা থাকে তবেই কালো ধোঁয়া বের হয়। আমরা মালিকদের বলি কিন্তু তারা যদি ঠিক না করে তাহলে আমাদের কিছু করার থাকে না। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দেখা যাদের দায়িত্ব, তারা দায় চাপাচ্ছেন একে অন্যের ঘাড়ে। তাই আইনের কঠোর প্রয়োগ ও জনসচেতনতায় জোর দিতে হবে।
মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী, এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোনো ধোঁয়া নির্গত হলে তা ২০০ টাকা জরিমানাসহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধোঁয়ার ফলে ক্যানসার হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে। শিশুদের জন্যও ক্ষতিকর। গত কয়েক দিন বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়ক ঘুরে দেখা যায়, যানবাহনের মধ্যে বাস থেকে কালো ধোঁয়া বেশি নির্গত হয়। এর মধ্যে পুরোনো ও লক্করঝক্কর বাস থেকে হয় বেশি। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচলকারী তিশা, সেনমাট্রিনসহ বেশ কিছু বাসে এ অবস্থা দেখা যায়। মহাসড়কের সীতাকুন্ড এলাকায় সেনমাট্রিন পরিবহনের চালককে ধোঁয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলেন, এগুলা মালিকে জানে। আমার কাজ বাস চালানো। বাস ছাড়া লেগুনা, ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাসও এ তালিকায় রয়েছে। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের গৌরপুর থেকে রায়পুর যাবার রাস্তায় সকাল ও বিকেলের একটা বড় সময় জ্যাম থাকে। জ্যামের সঙ্গে থাকে গাড়ির কালো ধোঁয়ার আধিক্য। এই মহাসড়কের কয়েকটি স্থানে ট্রাফিক দায়িত্বে থাকলেও দূষণ নিয়ন্ত্রণে আলাদা কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। তবে বায়ু দূষণের দিক থেকে ঢাকা শহর বিশ্বের অন্য যে কোনো বড় শহরের চেয়ে অনেক বেশি। এখানকার বাতাসে এত বেশি দূষিত পদার্থ মিশে আছে যে কোনো সাধারণ মানুষই রাজপথে হাঁটতে গেলে টের পাবেন। গতকাল দুপুরে কারওয়ান বাজার এলাকায় কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউতে মতিঝিলগামী নিউ ভিশন, দিশারি, বিকল্পসহ অনেক বাস থেকেই কালো ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। সার্ক ফোয়ারা মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষারত আমেনা আক্তার মুখে মাস্ক পরে কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন। ধোঁয়ার কথা বলতেই বিরক্তি নিয়ে বলেন, এমনিতেই ঢাকার বাতাস খুব খারাপ। এর ওপর প্রতিদিন এই ধোঁয়া খেতে হচ্ছে। ইনহেলার সব সময় সঙ্গে রাখি। অ্যাজমা নিয়ে এই শহরে থাকা কঠিন। হাতিরঝিলে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা আনোয়ার হোসেন অনেকটা বিরক্তি নিয়ে বলেন, ভাই ঢাকায় এখন রাস্তায় বের হওয়া দায়। আগে শুধু জ্যামের অজুহাত ছিল। এখন ঠিকমত নিঃশ্বাস নিতে পারি না।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুদ্দিন বেননুর বলেন, এসব গাড়ির পেট্রোলিয়াম আংশিক জ্বলে। ফলে বাতাসে বিষাক্ত পদার্থ বের হয়। মূলত সিসা–জাতীয় পদার্থ, যেটা শ্বাসতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। তিনি আরো বলেন, এ ধোঁয়ার প্রভাব সরাসরি শিশুদের ওপর পড়ে। মানসিক বিকাশে সমস্যা হয়। এ ছাড়া কালো ধোঁয়া মানেই হলো কার্বন মনোঅক্সাইড, ডাই–অক্সাইড এবং ধাতব পদার্থ মূলত সিসা। এগুলো মানুষের শরীরে গেলে ফুসফুস, লিভার ও কিডনিতে জটিলতা তৈরি করে এবং নারী পুরুষের বন্ধ্যাত্ব তৈরি করতে পারে। বায়ু দূষণের একটি বড় উপাদান এই কালো ধোঁয়া। শিশুদের জন্য এর প্রভাব মারাত্মক। এটি আমাদের বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউজ এফেক্ট বাড়িয়ে দেয়। এর কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ে, জলবায়ূ পরিবর্তনে প্রভাব রাখে। তিনি আরো যোগ করেন, রাস্তায় যাদের দীর্ঘ সময় থাকা হয় অর্থাৎ ট্রাফিক পুলিশ, পরিবহন শ্রমিক ও রাস্তার পাশের দোকানি, তাদের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বায়ুদূষণ বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, গাড়ির কালো ধোঁয়া বের হয়ে বাতাসের ধুলাবালিসহ অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিশে বিষাক্ত রাসায়নিক বস্তুতে পরিণত হয়, যা জীবনের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়াও অনেক সময় তেলের পাম্পগুলোতে জ্বালানি তেলের গুণগত মান ঠিক না থাকলেও কালো ধোঁয়া তৈরি হতে পারে। আবার যে জ্বালানি ব্যবহার করা হয়, সেটাও অনেক সময় ভালো মানের থাকে না। এটাও দূষণের কারণ। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। আগের থেকে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। যোগাযোগে নতুন বিপ্লব হয়েছে। কিন্তু সড়কে যে বাস চলছে এগুলো দেখলে মনে হয় আমরা গরিব দেশে বসবাস করছি। সরকার সড়ক ব্যবস্থাকে উন্নত করলেও বাসগুলোর দিকে সেভাবে নজর দিচ্ছে না। যার জন্য বছরের পর বছর ধরে কালো ধোঁয়া ছাড়া ফিটনেসবিহীন বাস সড়কে চলছে। তিনি আরো বলেন, আমরা সাধারণ যাত্রীরা একদিকে বাসে বসে ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। আবার সড়কে কালো ধোঁয়া ছাড়া বাসের জন্য অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে নগরজীবন। এসব বাস অপসারণ করে সড়কে ভালোমানের বাস নামানো দাবি জানাচ্ছি সরকারের কাছে। দেশে মোটরযান অধ্যাদেশ আইন আছে, রয়েছে জরিমানার বিধানও। তবে তা দেখভালের দায়িত্ব যাদের, একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে তাদের বক্তব্যটাও যেন দায়সারা। বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, যানবাহনের কালো ধোঁয়া বের হওয়ার বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদফতরের। ফিটনেসের বিষয়ে বিআরটিএ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও কালো ধোঁয়ার বিষয়টি দেখবে পরিবেশ অধিদফতর।
পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। গাড়ির কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের একটা বড় দায়িত্ব থাকে ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর। তবে রাস্তায় দেখা গেছে, ট্রাফিক পুলিশের সামনে দিয়েই গাড়ি কালো ধোঁয়া নির্গত করে চলে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ফিটনেসবিহীন গাড়ি আটক করা হলেও সেটি ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। গুলশান বিভাগের ট্রাফিক সহকারী পুলিশ কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিদিন আমাদের সার্বিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমরা ফিটনেস সার্টিফিকেট দেখি। এটা আমাদের রেগুলার ওয়ার্ক। কালো ধোঁয়া কোনো গাড়ি থেকে নির্গত হলেই আমরা সেটিকে আটক করি। সেটির ফিটনেস কাগজ দেখি। এটা চলমান প্রক্রিয়া। তবে পরিবেশ কেন্দ্রিক কালো ধোঁয়ার যে প্রভাব, সেটি নিয়ে আমরা আলাদা অভিযান করি না। আমাদের ট্রাফিক যারা আছেন, তারা যদি দেখেন কোনো গাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, তবে সেটিকে তারা আটক করেন। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়।