দলের নিয়মিত ক্রিকেটারদের ৫ জনকে হারিয়ে বিপাকে ছিল অস্ট্রেলিয়া। পরিবর্তে যাদের নেওয়া হয়েছিল, তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি খুব ভালো ছিল না। তার ওপর লক্ষ্যটা ছিল আকাশ ছোঁয়া। তবে জশ ইংলিসে রেকর্ড অপরাজিত দুর্দান্ত সেঞ্চুরি ও অ্যালেক্স ক্যারির সঙ্গে রেকর্ড জুটির কল্যাণে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রেকর্ড গড়া এক জয় পেল দলটি। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ইংলিশদের ৫ উইকেটে হারিয়েছে অজিরা। লাহোরে শনিবার চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সর্বোচ্চ দলীয় স্কোরের রেকর্ড কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে লেখা হলো দুবার। যেখানে বেন ডাকেটের ১৬৫ রানের রেকর্ড গড়া ইনিংসে ইংল্যান্ড প্রথমে ব্যাট করে ৩৫১ রান তোলে। সেই রান অস্ট্রেলিয়া পেরিয়ে যায় ১৫ বল বাকি থাকতেই। এটি আইসিসির যেকোনো পঞ্চাশ ওভারের টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রান তাড়ায় জয়। এর আগে ২০২৩ বিশ্বকাপে হায়দরাবাদে শ্রীলংকার বিপক্ষে পাকিস্তানের ৩৪৫ রানের লক্ষ্য তাড়ায় জয় ছিল আগের রেকর্ড।
অন্যদিকে এই ম্যাচের চেয়ে বেশি রান তাড়া করে অস্ট্রেলিয়া জিতেছে আর একবারই। ২০১৯ সালে মোহালিতে ভারতের বিপক্ষে ৩৫৯ রানের লক্ষ্য তাড়ায় ৪ উইকেটে জিতেছিল তারা। অধিনায়ক প্যাট কামিন্স, পেসার জশ হেইজেলউড ও মিচেল স্টার্কসহ নিয়মিত বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারকে হারানোর ধাক্কা, টানা চার ওয়ানডেতে হার। পাশাপাশি সবশেষ ম্যাচে রান তাড়ায় ১০৭ রানে গুটিয়ে যাওয়ার দুঃস্মৃতি– সবকিছুকে পেছনে ফেলে স্মরণীয় এক জয় পেল অস্ট্রেলিয়া।
ইংলিসই মূলত এই জয়ের নায়ক। গত মাসে শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকে ৯০ বলে সেঞ্চুরি করা এই কিপার–ব্যাটার এবার প্রথম ওয়ানডে শতক পূর্ণ করেন স্রেফ ৭৭ বলে, যা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে যৌথভাবে দ্রুততম। ৬ ছক্কা ও ৮ চারে ৮৬ বলে অপরাজিত ১২০ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ–সেরা স্বীকৃতি পান তিনিই। এদিন পার্শ্বনায়ক ছিলেন ক্যারি। ১৩৬ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর ইংলিসের সঙ্গে ১১৬ বলে ১৪৬ রানের জুটিতে দলকে লড়াইয়ে ফেরান তিনি। ৮ চারে তিনি খেলেন ৬৩ বলে ৬৯ রানের ইনিংস। মূলত কিপার হলেও এ দিন আউটফিল্ডে ক্যারি ক্যাচ নেন তিনটি, যার একটি ছিল চোখে লেগে থাকার মতো। তাদের এই জুটি অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ওয়ানডেতে পঞ্চম উইকেটে রেকর্ড। ১৯৯৩ সালে এজবাস্টনে ইংল্যান্ডের গ্রাহাম থর্প ও রবিন স্মিথের ১৪২ রানের জুটি ছিল আগের সর্বোচ্চ।
ইংল্যান্ড বোলিংয়ে ম্যাচে ফেরার একটা সুযোগ পেয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার দরকার যখন ৭৩ বলে ১০৪ রান, কেয়ারির সহজ ক্যাচ ফেলেন জোফরা আর্চার। পরে জুটিতে যোগ হয় আরও ৩৪ রান। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে নিয়ে বাকিটা সারেন ইংলিস। যেখানে বিস্ময়কর হলেও সত্যি, ২০০৯ আসরের ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের পর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম জয় এটি! ২০১৩ আসরে তারা হেরেছিল দুটি ম্যাচ, বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল একটি। ২০১৭ আসরে বৃষ্টিতে পণ্ড হয়েছিল তাদের দুটি ম্যাচ, একটিতে হেরেছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। অস্ট্রেলিয়ার বড় লক্ষ্য তাড়ায় শুরুটা ছিল ভীষণ নড়বড়ে। প্রথম পাঁচ ওভারে ২৭ রানের মধ্যে বিদায় নেন ট্রাভিস হেড ও ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ। দলকে টানেন এরপর ম্যাথু শর্ট ও মার্নাস লাবুশেন। তৃতীয় উইকেটে এই দুজন গড়েন ৯৫ রানের জুটি। ৪৫ বলে ৪৭ রান করে লেগ স্পিনার আদিল রাশিদের বলে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন লাবুশেন। ফিফটি করে এগিয়ে যান শর্ট। তার ৬৬ বলে ৬৩ রানের ইনিংস থামে লিয়াম লিভিংস্টোনকে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে। তখনও প্রায় ২৮ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার দরকার ২১৬ রান। ইংলিস ও কেয়ারির লড়াই শুরু সেখান থেকেই। ইংলিস ফিফটি পূর্ণ করেন ৪১ বলে, জুটির শতরান স্পর্শ করে ৭৮ বলে। ৪৯ রানে রাশিদের বলে ডিপ মিডউইকেটে কেয়ারির ক্যাচ ফেলেন আর্চার, ওই বলে দুই রান নিয়ে ফিফটি পূর্ণ করেন এই ব্যাটসম্যান। গলার কাঁটা হয়ে ওঠা জুটি ভাঙেন অবশেষে ব্রাইডন কার্স। কেয়ারির ফেরার সময় অস্ট্রেলিয়ার দরকার ছিল ৫০ বলে ৭০ রান। কার্সকে পরপর দুই ছক্কায় ইংলিস পৌঁছে যান নব্বইয়ের ঘরে। পরের ওভারে আর্চারকে ছক্কা উড়িয়ে ৭৭ বলে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন তিনি। ২০০২ আসরে কলম্বোয় ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই ৭৭ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন ভারতের বীরেন্দ্র শেবাগ।
পরের ওভারে উডকে চার ও ছক্কা মারেন ম্যাক্সওয়েল। এর পরের ওভারে আর্চারকেও চার ও ছক্কা মারেন তিনি। মাঝে ফুল টসে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান তিনি ‘নো’ বলের কারণে। এরপর ৪৮তম ওভারে ইংলিসের ওই অস্ট্রেলিয়ার জয়োল্লাস। ২টি ছক্কা ও ৪টি চারে ১৫ বলে ৩২ রান করেন ম্যাক্সওয়েল। টস হেরে এর আগে ব্যাটিং নামে ইংল্যান্ড। প্রথম ওভারে স্পেন্সার জনসনকে পরপর চার ও ছক্কা মারলেও, পরের ওভারে বিদায় নেন ফিল সল্ট। এই উইকেটকে নিজের বলে দাবি করতেই পারেন কেয়ারি! মিড অফে একটু সরে গিয়ে শরীরটা শূন্য ভাসিয়ে এক হাতে চোখধাঁধানো ক্যাচ নেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবার তিন নম্বরে নেমে টিকতে পারেননি জেমি স্মিথ। দুজনকেই ফেরান বেন ডোয়ার্শিস। ৪৩ রানে ২ উইকেট হারিয়ে ফেলা দলকে টানেন ডাকেট ও জো রুট। ডাকেট পঞ্চাশে পা রাখেন ৪৯ বলে, রুটের লাগে ৫৬ বল। রুটকে (৭৮ বলে ৬৮) এলবিডব্লিউ করে ১৫৮ রানের বড় জুটি ভাঙেন লেগ স্পিনার অ্যাডাম জ্যাম্পা। পরের ওভারে ডাকেট তৃতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ৯৫ বলে।
হ্যারি ব্রুক, জশ বাটলার, লিভিংস্টোনরা প্রত্যাশিত ঝড় তুলতে পারেননি। অন্য প্রান্তে ম্যারাথন ব্যাটিংয়ে এগিয়ে যান ডাকেট। ৪৮তম ওভারে থামে ১৭ চার ও ৩ ছক্কায় গড়া তার ১৪৩ বলে ১৬৫ রানের ইনিংস। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রথম দেড়শ ছোঁয়া ব্যক্তিগত ইনিংস এটি। শেষ দিকে আর্চারের ১০ বলে ২১ রানের ক্যামিওতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রথম সাড়ে তিনশ ছোঁয়া স্কোরের কীর্তি গড়ে ইংল্যান্ড। তবে তাদের সেই রানও যথেষ্ট হলো না। দারুণ এক সেঞ্চুরিতে ম্যাচ বের করে নিলেন ইংলিস।