ভাষাকে অনেকগুলো ভাগে ভাগ করা চলে, যেমন লিখিত ভাষা, আর কথ্য ভাষা। আর একটি ভাষা ব্যবহৃত হতে দেখা যায় যা হলো সাংকেতিক ভাষা। তাছাড়া একটু গভীরে আলোচনা করা হলে দেখা যাবে, চোখের ভাষা রয়েছে, মনের ভাষা রয়েছে, হৃদয় জুড়ে ভাষা আছে ঠাসা, বা খাসা।
ক্ষণকালের ক্ষণভঙ্গুর ব্যক্তি আর কতটা ভাষায় অধিকার রাখে। মানুষ অবশ্যই সীমাবদ্ধ, তাই তাকে ২/৪টি ভাষার মধ্যে থাকতে হয় সসীম। তবে মজার বিষয় হলো, বিশ্বের যাবতীয় ভাষার রয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ব্যক্তির মনের গভীরে লুকায়িত আশা–আলো জীবন ও জীবনের বিকাশ সহায়ক বিষয়াদি নিয়ে জন্ম নিয়েছে ভাষা; তা কথ্য হোক বা লেখ্য হোক! চোখের ভাষা বলুন আর চার চোখের মিলন ও বিনিময়যোগ্য লেনাদেনা দু’প্রান্তে অবস্থানরত দু’টি প্রাণ এক সূত্রে গেঁথে দেবার জন্যই হয়ে থাকে রচিত, বিকশিত, প্রকাশিত ও সাধিত।
ফুল ফলের যেমন স্তর ভিত্তিক নাম থাকে, তদ্রূপ মানুষের শিশুকাল থেকে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত অনেকগুলো নাম উপাধি দিয়ে তাকে চিহ্নিত করে দেয়ার রেওয়াজ রয়েছে সমাজে; তেমন ক্ষেত্রে ভুল উপাধি কেউ মেনে নিতে চায় না। তাছাড়া বয়বৃদ্ধির সাথে সাথে তার দায়িত্ব কর্তব্য অধিকার মান–মর্যাদা পরিবর্তীত হতে থাকে। মান–মর্যাদার প্রশ্নে একই কথা ভিন্ন ভিন্ন উপাধিতে পরিচিত করিয়ে দেয়া হয়। সমকক্ষের সমমর্যাদার প্রশ্নে এক উপাধি, যেমন বন্ধু বন্ধুকে বললো, “তা তুমি কি কথা বলেছো, পুনরায় বলো।” বক্তব্য, ভাষণ, বাণী কেবল ভাষার পরিবর্তন নয়, তেমন ক্ষেত্রে মান–মর্যাদার প্রশ্ন রয়েছে জড়িত। যেমন নেতার বক্তব্য, প্রধানের ভাষণ আর প্রেসিডেন্টের বাণী, অবশ্য খোদার কথাকে আমরা ঐশি বাণী হিসেবে সম্মান দিয়ে থাকি।
মজার বিষয় হলো, প্রত্যেকটি লিখিত ভাষা কাগজ, পাথর, তাম্রপাত কলাপাতা, তালপাতা, পেপিরাস বাকল যখন যেমন যে ব্যবস্থা সহজলভ্য ছিল, তেমন ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা হয়েছে; আর এর সবগুলো কালির শৈল্পিক টানাটানি। কথাটা পুণরায় বলি, একটি কলম দিয়ে কাগজের উপর আকিঝুকি করে চলছেন, অবশ্য আপনার জানা ও শেখা কৌশলে, আর তা কতিপয় ব্যক্তির কাছে অর্থবহ একটি দলিল হিসেবে পেয়ে গেল মর্যাদা।
পৃথিবীতে অগণিত ভাষা রয়েছে, প্রশ্ন জাগে, তা লিখতে হলে অগণিত কলমের প্রয়োজন থাকবে হয়তো! যেমন আরবি কলম আরবি লেখার জন্য, ইংরেজি কলম ইংরেজি লেখার জন্য, বাংলা কলম বাংলা লেখার জন্য এমনি করে হাজার হাজার কলমের সমাহার ঘটাতে হবে যাবতীয় ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য! কি মনে করুন? বাস্তবে সম্পূর্ণ উল্টো, লেখার জন্য চাই কালী ভরা কলম, তবে কালীমাখা হলে চলবে না, কেউ তেমন কলম ব্যবহার করে না, যে কলম বহুস্থান থেকে অন্তরের কালী নিয়ত ঝরাতে ক্ষরাতে থাকে, তাতে হাত নষ্ট ও পকেট নষ্ট হবার ভয় থাকে। যদিও উক্ত কালী দিয়ে বিশে^র যাবতীয় লিখিত বাণী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, তবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে যেখানে সেখানে কালী ঢেলে দিয়ে সবকিছু কলঙ্কিত করা চলে, কোনো সঠিক শিক্ষা দেয়া সম্ভব নয়।
ভাষার ভিন্নতার প্রশ্নে আমার পরিষ্কার জবাব হলো এমনভাবে কলম চালনা করা যা কেবল কতিপয় ব্যক্তি বুঝতে পারে। অন্যের জন্য তাদের পায়ের কাছে বসে শিখে নিতে হবে! ব্যক্তি অন্তরের গভীরে পুষে রাখা যাবতীয় বিষয় নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির কাছে খুলে বলে, পত্র লিখে প্রকাশ করতে পেরে স্বস্তি লাভ করে। যেমন প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে পেরে লাভ করে প্রশান্তি।
মানুষ মানুষের স্বজন–প্রিয়জন। একজন আর একজনের মনের কথা বুঝতে পারে এবং তদুনযায়ী যখন অটুট একাত্মতা ঘোষণা করে, ঠিক দুজন হয়ে গেল স্বজন–প্রিয়জন। কেবল জন্মসূত্রেরই যে স্বজন প্রিয়জন সম্পর্কে নীতি হলো, তাই নয়, চাই মনের সাথে মনের মিল; অমনি বনে গেল মানিকজোড়, সুহৃদ, প্রাণের প্রাণ, জানের জান।
কথায় বলে, আপনার পত্র পাঠ করে সম্পূর্ণ বুঝতে পেরেছি, তবে ঐকমত্যে আসা গেল না! এক্ষেত্রে দেখা যায়, পত্রটি আনুপূর্বিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাঠ করেছে, প্রত্যেকটি লাইনের দিকে চোখ বুলিয়েছে, পত্রের মর্মার্থ অনুধাবন করেছে, তাই তার সাথে ঐক্যে আসা আর গেল না। আপনার মনের কথা যেমন আমাকে বুঝতে হবে, আবার দেখতে হবে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুসারে তা প্রয়োগযোগ্য কিনা, জনসমক্ষে তা তুলে ধরা চলবে কিনা। অনেক কিছু বিবেচনা করেই তবে একজন আর একজনের প্রস্তাবে রাজী হয়।
তবে ভাষার যতই ভিন্নতা থাক না কেন, আশার অভিন্নতা পাওয়া গেলে সহমত পোষণ করা সম্ভব। মতে মতে মিল হলে বিরুদ্ধ বাদীদের থেকে পাওয়া উপাহার স্বরূপ কিল–ঘুষিতেও খুসির ঘাটতি দেখা যায় না। দু’টি মন আর নেই দুজনার…।
তা দুটি মন, যারা কারো নয়নের মণি হিসেবে অপরুপ সৃষ্টি, যিনি স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে মান–মর্যাদা মেধা বিদ্যাবুদ্ধি গঠন দিয়ে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের নিমিত্তে সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি এদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করার অধিকার রাখে না! প্রশ্নটি এক্ষেত্রে সকলের কাছে প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরতে চাই।
খোদা আপন সুরতে, স্বীয় নয়নের মণি করে প্রজ্ঞা ধার্মিকতা দিয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তিনি অবশ্যই ঘোষণা করেছেন এক মহান পরিকল্পনার কথা, যা কল্যাণ আর কল্যাণে পরিপূর্ণ, উদ্বেগের কোনো কারণ হেথা খুঁজে পাবার নেই, নেই তাদের উদ্বেগাকুল হবার কোনো কারণ; ব্যক্তি ও খোদার মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক সৃষ্টি করে রেখেছেন, ব্যক্তি যখন তেমন সম্পর্কের দূয়ার খুঁজে পায়, তবে তো সহজ হলো দুজন দুজনার সাথে একাকার হওয়া।
খোদা হলেন নিরাকার এক রুহানী সত্ত্বা (ইউহোন্না ৪ : ২৪)। আর মানুষ রয়েছে জড় খাঁচার মধ্যে বন্দি। মানুষের পক্ষে খাঁচা ভেঙ্গে বের হওয়া সম্ভব না হলেও, খোদা স্বীয় সীমাহিন প্রেমের তাগিদে বন্দি শিবিরে ছুটে এসে মানুষের সাথে হয়ে গেলেন একাকার; বাতেনী খোদা মানবরূপী কালাম কালেমাতুল্লাহর মাধ্যমে, পরিশ্রান্ত ভারাক্রান্ত আশাহত মানুষের সাথে একাকার হয়ে গেলেন, অভয়বানী শুনালেন, প্রবোধ শান্তনা যোগালেন, যেন তাদের উদ্বেগের কারণ সমূহ মানবরূপী খোদার স্কন্ধে তুলে দিয়ে নিজেরা হতে পারে ভার মুক্ত, উদ্বেগহীন; মানব খোদায় যখন একাকার হয়ে গেল, তখন পার্থীব ঠুনকো কোনো অন্তরায় আর ঠেকিয়ে রাখতে পারলোনা মানুষে মানুষে মিলন ভ্রাতৃত্বের আনন্দমেলা উদযাপনের। শত বাঁধা, ভুল ব্যাখ্যা, জুজুবুড়ির ভয় আজ আর কার্যকর রলো না, “সবার উপর মানুষ সত্য” কথাটি প্রমাণ করার জন্য।
বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব আজ এক হয়ে গেছে। আর তা সম্ভব হয়েছে খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসিহের পূতপবিত্র রক্তের মূল্যে। যতজন মসিহের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় পেল তারা একসাথে এক পবিত্র নবীন জাতিতে পরিণত হয়ে গেল। পূর্বের বিঘ্নগুলো এখন আর কার্যকর থাকলো না। সকলেই এক আত্মা, একমন, এক অভিধা নিয়ে বিশ্বে রয়েছে জাগরুক “মসিহ ঈসার উপর ঈমানের মধ্য দিয়ে তোমরা সবাই আল্লাহর সন্তান হয়েছ” (গালাতীয় ৩ : ২৬)।