বইমেলায় নবীন ও তরুণ জনপ্রিয় লেখকদের বই বিক্রির শীর্ষে থাকলেও হারিয়ে যাননি কিংবদন্তি লেখকরা। তারা সামাজিক নানা চিত্র গভীর ভাবে ফুটিয়ে তোলেন উপন্যাসে। জনপ্রিয় লেখকের ভীড়ে ভালো বিক্রি হচ্ছে তাদের এসব উপন্যাস। ফাগুনের এই বসন্তের আবহে বিক্রি হচ্ছে উপন্যাস ও সিরিজ গল্পের বই। পছন্দের লেখকদের বই খুজতে স্টল থেকে স্টলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বইপ্রেমীরা। পছন্দের তালিকা থেকে হারিয়ে যায় নি কালজয়ী লেখকরা, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কবি ও উপন্যাস লেখকদের কদর কমেনি একটুও। বই মেলায় এসব লেখকদের উপন্যাস বিক্রির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
একুশে বইমেলার ফাগুনের রেশ যেন এখনও কাটেনি। পাঠক–দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়ে জমে উঠেছে প্রাণের বইমেলা। বইপ্রেমীদের টানে প্রতিনিয়তই বাড়ছে বই সাথে পাঠকদের ভিড়। গতকাল বইমেলার একাধিক স্টল ঘুরে জানা যায়, ফাগুন ও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে সর্বাধিক বিক্রি হচ্ছে উপন্যাস। তবে দর্শকের তুলনায় বিক্রি কম হয়েছে। তরুণ তরুণীদের বিভিন্ন উপন্যাসের চাহিদা ছিল বেশি, হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস বিক্রি হয় বেশি। ক্রেতাদের থেকে দর্শকের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।অন্যান্য সাহিত্যে তুলনায় উপন্যাস ও গল্প বই বিক্রি বেশি বলে জানান বিক্রেতারা।
বিক্রেতাদের মতে, বইমেলায় দিন যত পার হচ্ছে ক্রেতাদের আনাগোনা তত বাড়ছে। প্রথম দিকের বইমেলায় ক্রেতার থেকে দর্শনার্থীদের সংখ্যাই বেশি থাকে। যার ফলে ভিড় বেশি হয় কিন্তু বই কম বিক্রি হয়। তবে শেষের দিকে মূল ক্রেতারা আসেন এজন্য শেষ দিকে বিক্রিও ভালো হয়। আকাশ প্রকাশনীর জিয়াউল হাসান বলেন, বই বিক্রি বেড়েছে। কালও আশানুরূপ বিক্রিই হয়েছে। গতবারের মত এবারও আমাদের গোয়েন্দা সিরিজের বইগুলো বেশি চলছে। এবার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে ইফতেখার আমিনের অনুবাদ করা বই মোসাদ। এছাড়াও হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসগুলো পাঠকরা খুজে। কথাপ্রকাশ প্রকাশনীর বর্ষন বলেন, গতকালের চেয়ে আজ পাঠকও বেশি, বিক্রিও বেশি। গতকাল আশানুরূপ বিক্রি হয়নি। ধীরে বই বিক্রি বাড়ছে। এ বছর আমাদের মাহরীন ফেরদৌসের লেখা জলজ লকার ও সৈয়দ জাকির হোসেনের লেখা বোধগম্যতার গহীনে বইটি ভালো বিক্রি হচ্ছে। আদর্শ প্রকাশনীর সায়মাও একই কথা বলেন। মেলায় দিন যত গড়াচ্ছে বিক্রিও তত বাড়ছে। জুলাই কেন্দ্রিক লেখা কয়েকটা বই ভালো বিক্রি হচ্ছে। আহম্মেদ ফয়েজ সম্পাদিত সংবাদপত্রের পাতায় জুলাই গণঅভ্যুত্থান বইটির বিক্রির শীর্ষে। এছাড়াও পাহাড়ের লাল অভ্যুত্থান বইটিও ভালো বিক্রি হচ্ছে।
নারীদের প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির অভিযোগ:নারীদের প্রয়োজন ও সচেতনতা বৃদ্ধির কথা ভেবে একটি কর্নারে প্রাণ– আরএফএল গ্রুপের স্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্য ব্র্যান্ড ‘স্টে–সেফ’ স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রদর্শন করা হয়। বইমেলায় কেন ‘গোপন পণ্য’ বিক্রি করা হচ্ছে, সে নিয়ে আপত্তির ভিত্তিতে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান প্রদর্শনী ও বিক্রি বন্ধ করে অন্য কোনও পণ্য সেখানে উপস্থিত করতে প্রাণ– আরএফএলকে চিঠি দেয়। এর ভিত্তিতে গতকাল রবিবার প্রতিষ্ঠানটি মেলা থেকে তাদের পণ্যটি তুলে নেয়। বাংলা একাডেমি বলছে, ‘বই ছাড়া অন্যকিছু বিক্রির সুযোগ বইমেলায় নেই বিধায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে’, তবে চিঠির বিষয়ে তারা কিছু জানে না। আর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে— বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই তারা চিঠি দিয়েছে। আর ‘স্টে–সেফ’ নামে পণ্যের বিষয়ে এর উৎপাদক প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হয়— ‘মেলায় এটি কেবল বিক্রি করা হচ্ছিল, এমন নয়। ফ্রিও দেওয়া হচ্ছিল।
প্রাণ–আরএফএল প্রতিষ্ঠানটির অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার তৌহিদুজ্জমান বলেন,আমরা চিঠিটি পেয়েছি। এটাকে কেন্দ্র করে কোনও ইস্যু হোক, তা আমরা চাই না। যেহেতু আপত্তি উঠেছে, সেহেতু আজকের মধ্যে আমরা ‘স্টে সেফ’ কর্নার সরিয়ে ফেলছি। তবে এই পণ্য আমরা সেখানে বিক্রির পাশাপাশি ফ্রি স্যাম্পলিং করতাম। অনেক নারী মেলায় আসে, তাদের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে এটা করা হয়েছিল, এখন আমরা কুইট করছি। কিছু মানুষের দাবির ভিত্তিতে ন্যাপকিনের স্টল বন্ধের বিষয়ে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব সরকার আমিনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,বইমেলায় ডাইপার বা অন্যান্য পণ্য বিক্রি করা যাবে। এটাতো আর বাণিজ্য মেলা না। এটা নিয়ে আমরা স্পন্সরকে বলেছি, আপনারা স্পন্সর করেছেন, ভালো। কিন্তু এসব পণ্য বিক্রি করা যাবে না। বই ছাড়া অন্যান্য পণ্য বিক্রির নীতিমালা নেই। নারী অধিকারকর্মী মারজিয়া প্রভা বলেন, ‘মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ ১০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বলতে পারি— মাসিক সংক্রান্ত নানাবিধ ট্যাবু এখানে ভেঙেছে। মেয়েরা সচেতন হয়েছে এবং সুস্থভাবে মাসিক ব্যবস্থাপনা শিখেছে। সরকারি এবং বেসরকারি/ এনজিও স্বাস্থ্যকর্মীরা কমিউনিটিতে প্রতিনিয়ত এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রচারণা করছে বলেই মাসিক সুরক্ষা নিয়ে মেয়েরা সচেতন। মেয়েরা আগে ফার্মেসি থেকে প্যাড কিনতে লজ্জা পেতো। এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্যাড বিক্রি বেড়েছে। স্কুলে প্যাডের ব্যবস্থা থাকছে। তাই কমিউনিটিতে স্যানিটারি প্যাড নিয়ে যে ট্যাবু কাজ করতো, তা এখন সেই অর্থে নেই। নিজেদের প্রয়োজনেই এই ট্যাবু ভেঙেছে। তাহলে কাদের কাছে এই জিনিস নিষিদ্ধ লাগে? এই প্রশ্নটা আমার সবার প্রথমে মাথায় এসেছে।
গতকাল রবিবার একুশে বইমেলার ১৬–তম দিনে মেলায় নতুন বই এসেছে ১০৪টি। বিকেলে বইমেলার মূলমঞ্চে “জহির রায়হানের সাহিত্যকর্মে ঐতিহাসিক ঘটনার ‘বিচার” শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মাহবুব হাসান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহুল আহমদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মশিউল আলম এবং আহমাদ মোস্তফা কামাল। সহুল আহমদ বলেন, জহির রায়হান একাত্তরের বৈপ্লবিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই উত্তাল সময়ে তিনি বহুমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। একদিকে তিনি ঘটনার জন্ম দিচ্ছিলেন, অন্যদিকে ঘটনার বিবরণ বা বয়ান তৈরির কাজে লিপ্ত ছিলেন। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বাসিন্দাদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে জেনোসাইড শুরু করেছিল, তার প্রতিবাদেই তিনি নির্মাণ করেছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ নামে প্রামাণ্যচিত্র। জহির রায়হান একাত্তরের ঘটনাপ্রবাহকে বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছিলেন। তিনি বিবেচনা করেছিলেন, তামাম দুনিয়াতে যে ধরনের আন্দোলন চলছে একাত্তর তারই অংশ। সভাপতির বক্তব্যে মাহবুব হাসান বলেন, বিপুল সম্ভাবনা ও বিপুল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন জহির রায়হান। তাঁর সকল কাজের মধ্য দিয়ে জনগণের আকাক্সক্ষাই প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর সৃজনকর্ম গভীরভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা নানাভাবে লাভবান হতে পারি। লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেনÑ কবি ও গবেষক সুমন সাজ্জাদ এবং শিশুসাহিত্যিক শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া।