সেই পুরানো প্রমোদতরী টাইটানিকের প্রশ্নে আসা যাক, যার মধ্যে অভিযাত্রীদের মর্মান্তিকভাবে সলীল সমাধী ঘটেছিল। সকলের জানা পুরানো কথাটা নতুন করে বলার প্রয়োজন হলো, উক্ত জাহাজে কতজন যাত্রী এবং কতজন নাবিক দল ছিলেন যারা সকলেই জলে ডুবে মৃত্যু বরণ করে ছিলেন। যাত্রীর সংখ্যা ছিল আনুমানিক ২২০০ জন এবং নাবিক দলের সংখ্যা ছিল ১৫০০ জন।
আমার প্রশ্ন হলো, নাবিক এবং যাত্রী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, বিভিন্ন গোষ্ঠি, ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের সদস্য ছিলেন অবশ্যই। জাহাজে ভ্রমণ করার জন্য টিকেট কাটার পরে এবং জাহাজে আরোহন করার পরে তাদের সকলের ভিন্ন ভিন্ন নাম উপাধি উহ্য হয়ে একটি সাধারণ উপাধি পেল আর তা হলো ‘যাত্রী’। জাহাজ ডুবী হবার পরেও তাদের নামের সাথে আর একটি উপাধি যুক্ত হলো, আর তা হলো ডুবন্ত মানুষ। উদ্ধার টিম এসে যাদের রক্ষা করতে পারলো, যদি তেমনটা হয়ে থাকে, তবে তাদের একটাই নাম হবে যা হলো উদ্ধারপ্রাপ্ত।
প্রথম মানুষ আদমের অবাধ্যতার ফলে গোটাবিশ্ব পাইকারীহারে মাত্র একটি উপাধি পেল, আর তা হলো ‘গুনাহগার’। সকলে পাপ করেছে এবং খোদার গৌরব হারিয়ে ফেলেছে। “কারণ সবাই গুনাহ্ করেছে এবং আল্লাহর প্রশংসা পাবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে” (রোমীয় ৩ : ২৩), “ঈমান আসবার আগে শরীয়ত আমাদের পাহারা দিয়ে রেখেছিল এবং যতদিন না ঈমান প্রকাশিত হল ততদিন পর্যন্ত আমাদের বন্দী করে রেখেছিল” (গালাতীয় ৩ : ২৩)। গোটা বিশ্ববাসি আজ পাপ–পঙ্কে হাবুডুবু খাচ্ছে, এক আদম সন্তান আর এক আদম সন্তানকে কোনোভাবেই সাযাহ্য করতে পারছেনা। পাপের করাল গ্রাস থেকে অবমুক্ত করার জন্য মানুষের সার্বিক শ্রম ঘাম, কৃচ্ছ্রতা তথা ধর্মকর্ম সবটাই ঊন হতে বাধ্য। মানুষের ধার্মিকতা খোদার পবিত্রতার তুলনায় ছেড়া মলিন ন্যাকড়াসম। “আমরা প্রত্যেকে নাপাক লোকের মত হয়েছি আর আমাদের সব সৎ কাজ নোংরা কাপড়ের মত। আমরা সবাই পাতার মত শুকিয়ে গেছি, আমাদের গুনাহ্ বাতাসের মত করে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে গেছে” (ইশাইয়া ৬৪ : ৬)। নাজাত কেবল খোদার রহমতে হয়ে থাকে লভ্য। “আল্লাহর রহমতে ঈমানের মধ্য দিয়ে তোমরা নাজাত পেয়েছ। এটা তোমাদের নিজেদের দ্বারা হয় নি, তা আল্লাহরই দান। এটা কাজের ফল হিসাবে দেওয়া হয় নি, যেন কেউ গর্ব করতে না পারে। আমরা আল্লাহর হাতের তৈরী। আল্লাহ মসিহ ঈসার সংগে যুক্ত করে আমাদের নতুন করে সৃষ্টি করেছেন যাতে আমরা সৎ কাজ করি। এই সৎ কাজ তিনি আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন, যেন আমরা তা করে জীবন কাটাই” (ইফিষীয় ২ : ৮–১০)।
এবার আসুন, গুনাহের কারণে সকলেই উপাধি পেল ‘গুনাহগার’ আর খোদার অশেষ রহমতে যারাই ঈসা মসীহের পাপার্থক কোরবানির মাধ্যমে গুনাহমুক্ত হলো তাদের অবশ্যই বলতে হবে নাজাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ। সাগরবক্ষে মৃত অর্ধমৃত যাত্রীদের উদ্ধার করার পর যেমন একটি উপাধি হলো, একইভাবে গুনাহের সাগর থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের উপাধি হলো ‘নাজাতপ্রাপ্ত’। খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসীহ যাদের নাজাত দান করলেন তাদেরকেও একই উপাধি দিতে হবে। একজন নাজাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি তো মসীহের অবিকল প্রতিবিম্ব বা উপমা, যেমন মসীহ হলেন অদৃশ্য খোদার দৃশ্যমান প্রতিচ্ছবি, যাকে দেখার মাধ্যমে সকলে অদেখা খোদার পরিপূর্ণ পরিচয় লাভ করতে পারে। মসীহই হলেন এককভাবে বাতেনী খোদার দৃশ্যমান প্রতিরূপ। “এই পুত্রই হলেন অদৃশ্য আল্লাহর হুবহু প্রকাশ। সমস্ত সৃষ্টির আগে তিনিই ছিলেন এবং সমস্ত সৃষ্টির উপরে তিনিই প্রধান, কারণ আসমান ও জমীনে, যা দেখা যায় আর যা দেখা যায় না, সব কিছু তাঁর দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে”(কলসীয় ১ : ১৫–১৬)। খোদা যেমন নূর মসীহও হলেন তেমনই নূর, আর মসীহের সাথে যুক্ত হয়ে যারাই নতুন সৃষ্টি হিসেবে গড়ে ওঠেছেন তাদেরকেও তিনি জগতের নূরে পরিণত করেছেন। “যে কথা আমরা ঈসা মসিহের কাছ থেকে শুনে তোমাদের জানাচ্ছি তা এই– আল্লাহ নূর; তাঁর মধ্যে অন্ধকার বলে কিছুই নেই। যদি আমরা বলি যে, আল্লাহ ও আমাদের মধ্যে যোগাযোগ–সম্বন্ধ আছে অথচ অন্ধকারে চলি তবে আমরা মিথ্যা কথা বলছি, সত্যের পথে চলছি না” (১ইউহোন্না ১ : ৫–৬), “পরে ঈসা আবার লোকদের বললেন, “আমিই দুনিয়ার নূর। যে আমার পথে চলে সে কখনও অন্ধকারে পা ফেলবে না, বরং জীবনের নূর পাবে” (ইউহোন্না ৮ : ১২), “তোমরা দুনিয়ার আলো। পাহাড়ের উপরের শহর লুকানো থাকতে পারে না” (মথি ৫ : ১৪)। খোদা যেমন প্রেমের পরাকাষ্ঠা মসীহ খোদাই প্রেম প্রকাশ করেছেন গুনাহগারদেরর পাপের প্রায়শ্চিত্ত শোধকল্পে, নিজের পূতপবিত্র জীবন কোরবানি দেবার মাধ্যমে। তিনি মানুষকে যে কতোটা প্রেম করেন তার জীবন্ত জ¦লন্ত প্রমাণ হলো মর্মবিদারক সলিবে মসীহের কোরবানি “মনে রেখো, ইবনে–আদম সেবা পেতে আসেন নি বরং সেবা করতে এসেছেন এবং অনেক লোকের মুক্তির মূল্য হিসাবে তাদের প্রাণের পরিবর্তে নিজের প্রাণ দিতে এসেছেন” (মথি ২০ : ২৮)। দুমুর্খদের মুখে ছাই দিয়ে তিনি তৃতীয় দিবসে মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে প্রমাণ দিলেন, তিনি অনন্তকাল ধরে রয়েছেন জীবিত এবং তার ভক্ত অনুসারীদের নিয়ত সুরক্ষা, পরিচালনা এবং প্রেরণা দিয়ে চলছেন হারানো সন্তানদের খুঁজে বের করার জন্য। ‘কোথা কোন অভাজন, করিছে ক্রন্দন, ত্বরা ছুটে চলো করিতে চয়ন’ এ ছত্রটি হলো গানের একটি পংক্তি।
তিনি অবশ্যই সকলকে আজ্ঞা দিয়েছেন গোটা বিশ্ববাসীর কাছে নাজাতের বারতা পৌছে দেবার জন্য। “ঈসা গালীলের যে পাহাড়ে সাহাবীদের যেতে বলেছিলেন সেই এগারোজন সাহাবী তখন সেই পাহাড়ে গেলেন। সেখানে ঈসাকে দেখে তাঁরা তাঁকে সেজদা করলেন, কিন্তু কয়েকজন সন্দেহ করলেন। তখন ঈসা কাছে এসে তাঁদের এই কথা বললেন, “বেহেশতের ও দুনিয়ার সমস্ত ক্ষমতা আমাকে দেওয়া হয়েছে। একজন্য তোমরা গিয়ে সমস্ত জাতির লোকদের আমার উম্মত কর। পিতা, পুত্র ও পাক–রূহের নামে তাদের তরিকাবন্দী দাও। আমি তোমাদের যে সব হুকুম দিয়েছি তা পালন করতে তাদের শিক্ষা দাও। দেখ, যুগের শেষ পর্যন্ত সব সময় আমি তোমাদের সংগে সংগে আছি।” (মথি ২৮ : ১৬–২০)। এ আজ্ঞাটিকে গ্রেট কমিশন নামে মান্য করা হয়ে থাকে। বিশ্বের তাবৎ নাজাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ এক ও অভিন্ন। তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ বৈষম্য থাকতে পারে না। তাছাড়া নাজাত লাভ কোনো ব্যক্তি বিশেষের কর্মের বলে সাধিত হয় নি যে সে গর্ব করবে। তাই সকলে অবশ্যই সমমর্যাদাবান। “পাক–কিতাবে আগেই লেখা হয়েছিল, ঈমানের জন্যই আল্লাহ অ–ইহুদীদের ধার্মিক বলে গ্রহণ করবেন। ইব্রাহিমের কাছে এই কথা বলে আগেই সুসংবাদ জানানো হয়েছিল, “তোমার মধ্য দিয়েই সব জাতি দোয়া পাবে” (গালাতীয় ৩ : ২৮)।
অতএব, নাজাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে জাতপাতের যত প্রকার ভাগাভাগী তা মসীহের শিক্ষার পরিপন্থি ছাড়া আর কি হতে পারে বলুন? “ পিতা, তুমি যেমন আমার সংগে যুক্ত আছ আর আমি তোমার সংগে যুক্ত আছি তেমনি তারাও যেন আমাদের সংগে যুক্ত থাকতে পারে। তাতে দুনিয়ার লোকেরা বিশ্বাস করতে পারবে যে, তুমিই আমাকে পাঠিয়েছ। যে মহিমা তুমি আমাকে দিয়েছ তা আমি তাদের দিয়েছি যেন আমরা যেমন এক তারাও তেমনি এক হতে পারে, অর্থাৎ আমি তাদের সংগে যুক্ত ও তুমি আমার সংগে যুক্ত, আর এভাবে যেন তারা পূর্ণ হয়ে এক হতে পারে। তাতে দুনিয়ার লোকেরা জানতে পারবে যে, তুমিই আমাকে পাঠিয়েছ, আর আমাকে যেমন তুমি মহব্বত কর তেমনি তাদেরও মহব্বত কর ” (ইউহোন্না ১৭ : ২১–২৩)