আধা কিলোমিটার দীর্ঘ পাথরের গুহা। ভেতরে বাদুড়ের ওড়াউড়ি। ঢুকতেই গা ছমছম করে ওঠে। পাওয়া যায় রোমাঞ্চকর অনুভূতি। তবে কেবল গুহার ভেতরে নয়, পাহাড়ি ছড়া হয়ে গুহাটিতে যেতে যেতেও মেলে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। গুহাটি পরিচিত বাদুড়ের গুহা নামে। এটির অবস্থান রাঙামাটি সদর উপজেলার বালুখালী ইউনিয়নের কাইন্দে এলাকার গ্রামীণ সাধারণ বনে (ভিসিএফ)। গুহার কিছু অংশে কেবল দুপুরের দিকে সামান্য আলো ঢোকে। আর পুরোটাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজের নেতৃত্বে নয়জনের একটি দলের সঙ্গে যাওয়া হয় সেই গুহায়। সকাল সাড়ে সাতটার রাঙামাটি শহর থেকে রওনা দেন দলের সবাই। কাউন্দে গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল পৌনে ১০টা। সেখান থেকে ২০ মিনিট চাঁদের গাড়ি (জিপ) চেপে যেতে হবে। গাড়ি থেকে নামার পর কাইন্দে গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে চার থেকে পাঁচটি দোকান। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় খাবার, পানি নেওয়া হলো। দুর্গম পাহাড়ে পথ দেখাতে দলের সঙ্গী হলেন তিনজন গাইড।
বনের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে একটি পাহাড়ি ছড়া। ছড়ার নাম দোল হাটছড়া অর্থাৎ বাদুড়ের গুহার ছড়া। সেই ছড়া বেয়ে যেতে হয় বাদুড়ের গুহায়। আধা ঘণ্টা যাওয়ার পর দেখা গেল, ছড়াজুড়ে ছোট–বড় অসংখ্য পাথর। ছড়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প রাস্তা না থাকায় ছড়া ধরেই যেতে হবে। পাহাড়ি পথে হাঁটতে অনভ্যস্ত মানুষের জন্য ছড়ার ভেতর দিয়ে হাঁটা অনেকটা কঠিন, রয়েছে ঝুঁকিও। দুপুর ১২টার দিকে গুহার সামনে পৌঁছানো গেল। গুহাটির প্রস্থ প্রায় ১৫ ফুট। উচ্চতা ৩০ ফুটের মতো। গুহার ভেতর দিয়ে ছড়ার পানি বয়ে গেছে। জানা গেল, শুষ্ক মৌসুমে গুহায় যেতে পারলেও বর্ষায় পানির স্রোতের কারণে ভেতরে যাওয়া যায় না। গুহার ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ হাঁটার পর আর যাওয়া যাচ্ছিল না। বিকল্প পথ হিসেবে রশি টানিয়ে পাথর বেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন দলের সদস্যরা। তবে দেখা গেল, সেভাবে যাওয়া সম্ভব নয়। কিছু দূর এগোনোর পর ফিরে আসতে হয় সবাইকে। পরে সবাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এক দল বাঁশ ও গাছ দিয়ে সাঁকো তৈরি করে ভেতরে এগোনোর চেষ্টা করবে। অন্য দলটি বনজঙ্গল দিয়ে গিয়ে গুহার শেষ মাথা থেকে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে দেখবে। দুই দলের মধ্যে ছড়া দিয়ে যাঁরা গেছেন, তাঁরা গুহাটি পুরোপুরি দেখতে পেরেছেন। তবে অন্য দলটিকে ফিরতে হয়েছে শুধু বাদুড়ের ওড়াউড়ি দেখে।
গুহাজুড়ে রয়েছে কয়েক হাজার বাদুড়। দেশের অন্য কোনো এলাকায় একসঙ্গে এত বাদুড় দেখা যায় না। এর মধ্যে খুব ছোট দু–একটি বাদুড় দেখা যায়। এই বাদুড়গুলো দেশের আর কোথাও এর আগে দেখা যায়নি বলে জানালেন অধ্যাপক এম এ আজিজ। বাদুড়ের গুহায় পাথরের মধ্যে পাওয়া যায় একটি বিরল প্রজাতির ব্যাঙও। সেই ব্যাঙের নমুনা পরে ভারতে এবং মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। কাইন্দে গ্রামের কার্বারি (গ্রামপ্রধান) প্রেম লাল চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, বাদুড়ের গুহাটি দেখতে সারা দেশ থেকে মানুষ আসে। দীর্ঘ ৮ থেকে ১০ বছর ধরে আসছেন। যাঁরা আসেন, তাঁদের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে বাদুড়গুলোর জন্য বনটি সংরক্ষণ করে রেখেছি। এই বাদুড়গুহা দেখতে চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় এসেছেন। ২০১৪ সালে এটি গ্রামীণ সাধারণ বন ঘোষণা করা হয়। এ বন ও গুহা রক্ষার কারণে আমরা ছড়ার পানি পাচ্ছি।’