খোদার সৃষ্ট মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত। তিনি নিপুণ ও অতুল করে প্রত্যেকটি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ ভুল করে, তাই বলে খোদা তো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। যেমন এক মানুষ আর এক মানুষের সাথে তুল্য হবার নয়। এ দাবির অকাট্য প্রমাণ হলো মানুষের আঙ্গুলের চাপ। বর্তমান বিশে^ আনুমানিক শাত শত কোটি মানুষ বসবাসরত রয়েছে, এদের মধ্যে একজন মানুষের আঙ্গুলের চাপ আর একজন মানুষের আঙ্গুলের চাপের সাথে মিলাবার উপায় নাই।
খোদা এক একজনকে এক একটি দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আপন আপন দায়িত্ব পালনের হিসাব নিকাশ আলাদাভাবে দিতে হবে। একজনের আমলনামা দিয়ে আর একজনকে প্রশ্ন করা হবে না। নিজ নিজ কাজের হিসেব নিজেকেই পেশ করতে হবে।
কাজে কর্মে ত্রুটি বিচ্যুতি সকলেরই রয়েছে; জীবদ্দশায় তার সমাধান করে নিতে হবে। মানুষের ধার্মিকতা খোদার কাছে ছেড়া ঘৃণীত ন্যাকড়া তুল্য “আমরা প্রত্যেকে নাপাক লোকের মত হয়েছি আর আমাদের সব সৎ কাজ নোংরা কাপড়ের মত। আমরা সবাই পাতার মত শুকিয়ে গেছি, আমাদের গুনাহ্ বাতাসের মত করে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে গেছে” (ইশাইয়া ৬৪ :৬)। আদম জাতের মধ্যে এমন কেউ নেই যে থাকতে পেরেছে সম্পূর্ণ বেগুনাহ। তবে মজার বিষয় হলো, খোদা যেমন সম্পূর্ণ পবিত্র এবং প্রেম ও ক্ষমাধনে অসীম আধার, তেমনই তাঁর পাকরূহের মানবরূপে ধরাপৃষ্টে আবির্ভুত ঐশি মানব খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসীহ হলেন সম্পূর্ণ একক পবিত্র ব্যক্তি। খোদা যেমন মানুষকে নিরঙ্কুষ প্রেম করেন ও প্রেমের আতিসহ্যে অনুতপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন, মসীহ মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত শোধ দেবার জন্য ঐশি নিখুঁত মেষশাবক হিসেবে নিজেকে পাপার্থক কোরবানি দিলেন।
মসীহ মানুষকে রক্ষা করার জন্য চুড়ান্ত মূল্য পরিশোধ করেছেন। কাবিল থেকে শুরু করে আদম জাতির সকলেই লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, স্বার্থপরতা চারিতার্থ করার জন্য যেভাবে মানুষ কতল করেছে তার হিসেব জানতে পারলে বিবেকবান ব্যক্তি বিস্মিত ও হতজ্ঞান হতে বাধ্য। আসলে ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের চরিত্র জানার সহজ উপায় সকলের কাছে সহজপ্রাপ্য হয়ে ওঠে না। পাগলের প্রলাপের মত নিজেকে কৃত অপরাধের পাওনা শাস্তি থেকে রিসেট বাটনে পুশ করার ধৃষ্টতা দেখাবার প্রয়াশ নেই, তার ফলে যা ঘটে তা হলো অতীতের কৃত অপরাধের সাথে নতুন আর একটি অপরাধ যুক্ত হয়। এ যেন ঋণের হিসাব; কিস্তি মোতাবেক টাকা পরিশোধ করতে বিলম্ব হলে ঋণের অংক বৃদ্ধি পেয়ে যায় যা চক্রবৃদ্ধির ঋণ আকারে মূল টাকার সাথে যুক্ত হয়। যে ক্ষেত্রে সকল মানুষ পাপাচারে রয়েছে লিপ্ত, বলতে পারেন, আদম থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত আমরা সকলেই খোদাদ্রোহী, সকলেই ভ্রান্তির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি, তেমনি অবস্থায় মাত্র একজন ঐশি মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, মানব জাতিকে কৃতপাপের ছোবল থেকে বিষমুক্ত করার জন্য; যথাযথ ক্ষমতা ও অধিকার নিয়ে মহান খোদার একক ব্যবস্থা, যা দত্ত হয়েছে গোটা বিশ^বাসীর মুক্তির জন্য। তিনি হলেন খোদার এক বিশেষ রহমত। আর খোদা তো সুনিশ্চিতভাবেই জানেন, সকল মানুষ একই আদমের ঔরষজাত। মানুষে মানুষে যতই ভেদাভেদ থাক না কেন ওগুলো মানুষের অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কবি একটি গান লিখেছেন, ‘মানুষের মাঝে টানে অভেদ সীমানা, পশুর কাতারে তাদের করিবে যোজনা, রচিয়া মাটির মানুষ দিলেন প্রেরণা, খোদার নায়েব ভুমে অমোঘ ঘোষণা। বৃক্ষে ফলে দেখ ফুল, ফল, পাতা, রূপে, বর্ণে আকারে মিল নেই হেথা, ভেদাভেদ যতই থাকুক বাহিরে তা রয়, আসল কাজ হলো মানব সেবা’।
মানুষে মানুষে ভেদাভেদ শুরু হয়েছে প্রথমত: লোভ-লালসা, স্বার্থপরাতা অহংবোধ এবং ভাষা দিয়ে, এগুলো ব্যক্তিকে সমষ্টি থেকে আলাদা করে ফেলেছে। ধার্মিক-অধার্মিক তেমন ক্ষেত্রে বরাবর বলা চলে। যে ক্ষেত্রে ধর্মের অজুহাতে প্রকাশ্যে মানুষ কতল করা হয়, নরঘাতি পশুচরিত্রের ব্যক্তিবর্গ বিশ^টাকে নৃশুণ্য করার তাগিদে, তৎপর তারা নগর-বন্দর কচুকাটা ও তেমন পরিস্থিতিতে ধার্মিক অধার্মিক বলে সাব্যস্ত করার কোনো অবকাশ আছে কি? তবে পার্থক্য হলো, মাকড়সার জালের মত মশা-মাছি আটকে পড়ে আর ঈগলের মত বড় প্রাণী জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে যায়। যে ব্যক্তি হাজার হাজার মানুষ খুন করে হাত রঞ্জিত করে নিয়েছে, সকলে তাদের বাহাদুর বলে অভিহিত করে থাকে। আবার কেউ কাওকে একটি চড় মারলেও বিচারের দায়ে পড়তে হয়।
রাজ-রাজাদের জীবনেতিহাস জানার কি সুযোগ হয়েছে আপনার? তাদের প্রকৃত ইতিহাস জীবন চরিত জানতে পারলে স্তম্ভিত হয়ে যাবেন। আমরা খোদার অশেষ রহমতে অদ্যাবধি বেঁচে আছি। কালামের আলোকে যদি গবেষণা করার সুযোগ থাকে তবে নিজেকে খোদার হাতে সমর্পীত হবার আন্তরিক প্রেরণা পাবেন নিশ্চয়। মাবুদের কাছে পানাহ বা সুরক্ষার আকুতি জানাবার অব্যার্থ সুযোগ কেবল জীবদ্দশায়ই রয়েছে। শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করার পরে আপনার আমার হাতে আর কিছুই করার থাকবে না।
মাবুদের সাথে একাকার হবার সুযোগ তিনি সৃষ্টি করে রেখেছেন। স্বীয় পাকরূহ জগতে তিনি প্রেরণ করেছেন মানব শিশুরূপে, কুমারী মরিয়মের জঠরের মাধ্যমে। সকল মানুষের কাছে তিনি নিজেকে আত্মিয়তার বাধনে যুক্ত করলেন। খোদার মনোনীত রূহানী জীবন যেভাবে যাপন করতে হবে তা তিনি নিজের জীবন আচরণের মাধ্যমে প্রাঞ্জলভাবে প্রকাশ করেছেন। তিনি ভিতরে বাহিরে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ছিলেন। মানুষের কোনো ক্ষতি তাঁর দ্বারা সাধিত হয় নি। তিনি মৃত ব্যক্তিকে জীবন দান করেছেন। বিপথগামী ব্যক্তিদের সহজ-সরল খোদার পথে পরিচালনা করেছেন ও ফিরেয়ে এনেছেন। প্রয়োজনের তাগিদে তিনি মৃতকে জীবন পর্যন্ত দান করেছেন; অন্ধ, খঞ্জ, নুলা, বধির, কুঁজো ও ভূতাশ্রিত ব্যক্তিদের সুস্থ করেছেন, যা হলো খোদার একক এখতিয়ারের বিষয়। বাতেনী খোদার হুবহু প্রকাশ তো কেবল খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসীহ; তিনি যথার্থ দাবি করেছেন, তাঁকে দেখার অর্থ হলো বাতেনী খোদাকে দেখা; কেননা তিনি হলেন রূহানী সত্ত্বা যা ক্ষণকালের জন্য মানবরূপে ধরাপৃষ্টে কালাতিপাত করে গেছেন। তাঁর আবির্ভাবের কারণ আমরা দেখতে পাই; বাতেনী খোদাকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, খোদার মনোনীত পথে জীবন-যাপন করা, এবং বিশ্ববাসীর পাপের কাফফারা পরিশোধ দিয়ে পথ ভুলো মানুষকে পাপ ও ইবলিসের কবল থেকে অবমুক্ত করে পিতার সন্তান পিতার হাতে তুলে দেয়া। আর আমাদের জীবদ্দশায় চলতে গিয়ে যতবার অভিশপ্ত ইবলিসের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ি, তিনি আমাদের সাথে থেকে নিয়ত পরিচালনা করে চলছেন। তিনি অনন্ত প্রেমে আমাদের ধরে রেখেছেন, যে কারণে নির্ভয়ে আমরা মাবুদের দেয়া নির্ধারিত কাজ করে চলতে পারছি। তাঁর হাত থেকে খোদার মনোনীত কাওকে কোনো অপশক্তি ছিনিয়ে নেবার ক্ষমতা রাখেন না। “আমার মেষগুলো আমার ডাক শোনে। আমি তাদের জানি আর তারা আমার পিছনে পিছনে চলে। আমি তাদের অনন্ত জীবন দিই। তারা কখনও বিনষ্ট হবে না এবং কেউই আমার হাত থেকে তাদের কেড়ে নেবে না। আমার পিতা, যিনি তাদের আমাকে দিয়েছেন, তিনি সকলের চেয়ে মহান। কেউই পিতার হাত থেকে কিছু কেড়ে নিতে পারে না। আমি আর পিতা এক।” (ইউহোন্না ১০ : ২৭-৩০)।