পৌষের স্বল্পায়ু বিকেল তখন সন্ধ্যার দিকে ঢলে পড়েছে। নড়াইলের এক গ্রামীণ সড়কে স্থির দাঁড়িয়ে ঢাকা থেকে আসা যুবক রকিবুল হাসান নাভীদ। তাঁর চোখেমুখে মুগ্ধতা। কারণ, আকাশে তখন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ছে। তাদের কিচিরমিচির শব্দের সঙ্গে শীতের হাওয়া ও কুয়াশা মিশে অন্য রকম এক আবহ তৈরি করেছে। তা দেখে মুগ্ধ নাভীদ বলেন, ‘এত পাখি দেখে অনুভূতি প্রকাশ করা কঠিন। এখানে দ্বিতীয়বারের মতো এলাম। তবে আগেরবারের চেয়ে বেশি ভালো লাগছে।’ নাভীদ যে সড়কে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন, সেটা নড়াইলের কালিয়া উপজেলার খাসিয়াল ইউনিয়নের পানিপাড়া গ্রামের। জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ–পূর্বের এই গ্রাম অতিথি পাখির আগমনের কারণে এখন ‘পাখির গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ গ্রামে রয়েছে অরুণিমা রিসোর্ট গল্ফ ক্লাব। এখানে দুই হাজারের বেশি গাছপালা আছে। শীত মৌসুমের শুরু থেকেই সেসব গাছে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি আসে। সেই সঙ্গে পাখি দেখতে ছুটে আসেন পর্যটকরা। স্থানীয়রা জানান, প্রায় পৌনে ২০০ বিঘা জমির ওপর ২০০০ সালে রিসোর্টটি গড়ে ওঠে। সেখানে অতিথি পাখি আসছে ২০০৪ সাল থেকে। পাখিদের জন্য জায়গাটি নিরাপদ। সে কারণেই প্রায় ২০ বছর ধরে দূরদূরান্ত থেকে ঝাঁক বেঁধে উড়ে আসে ওরা। আশ্রয় নেওয়া দেশি–বিদেশি পাখির মধ্যে রয়েছে বক, বালিহাঁস, কাদাখোঁচা, পানকৌড়ি, হাড়গিলা, রাতচোরা, টিয়া, ময়না, মাছরাঙা, ঘুঘু, শ্যামা ইত্যাদি। সূর্য ওঠার আগেই পাখিগুলো কিচিরমিচির শব্দ তুলে নীড় ছেড়ে উড়ে যায় খাবারের সন্ধানে। বিকেল হলেই আবার ফিরে আসে। প্রতি বছর শীতে প্রায় ৮ মাস বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলতানে মুখর থাকে পানিপাড়া গ্রাম।
গোপালগঞ্জ থেকে আসা নাহিদা সুলতানা বলেন, ফেসবুকে ভিডিও দেখে এখানে এসেছি। বাস্তবে দৃশ্য অনেক বেশি সুন্দর। পাখির কোলাহল ও প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে খুব ভালো লাগছে। খুলনা থেকে আসা সরকারি বিএল কলেজের শিক্ষার্থী খাদিজা খাতুন তন্বী বলেন, পানিপাড়া গ্রামে অনেক পাখির বসবাসের কথা দীর্ঘদিন ধরেই শুনছি। অবশেষে নিজ চোখে দেখতে এলাম। একসঙ্গে এত পাখির ডাক শুনতে ও আকাশে দল বেঁধে উড়তে দেখে বেশ ভালো লাগছে। নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কেয়া রেণু রায় বলেন, কয়েক বছর আগে শীত মৌসুমে জেলার বিভিন্ন খাল–বিল ও জলাশয়ে অতিথি পাখির বিচরণ থাকলেও কালের বিবর্তনে তা কমেছে। তবে পানিপাড়া গ্রামে প্রতিবছর পাখির সংখ্যা বাড়ছে। পরিযায়ী পাখি আমাদের প্রকৃতির জন্য খুব উপকারী। তবে পাখির বসবাসের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত এবং অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে হবে। পাখি শিকার বন্ধে যে আইন রয়েছে, তার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
অরুণিমা রিসোর্ট গল্ফ ক্লাবের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রজননের সুযোগ–সুবিধা থাকায় এখানে পাখির অভয়ারণ্য তৈরি হচ্ছে। পাখি নিরাপদ রাখতে গ্রামবাসী সাহায্য করলেও কিছু শিশু–কিশোর বিশেষ ফাঁদ দিয়ে পাখি শিকার করছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। তারা বিষয়টি দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।