আওয়ামী আমলে রাজশাহীতে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দমনে মাঠে নেমেছিলেন র্যাব–পুলিশের তিন শীর্ষ কর্মকর্তা। তারা ছিলেন র্যাব–৫ এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান, আরএমপির কমিশনার ডিআইজি এসএম মনির–উজ–জামান ও ডিআইজি মো. শামসুদ্দিন। তাদের সময়েই রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন চলেছে। ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ নাটকের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এই তিন কর্মকর্তা। তাদের পরিকল্পনায়, বিশেষ করে জামায়াত–শিবিরের নেতাকর্মীদের ধরে ধরে নির্মম নির্যাতনের পর কখনো ক্রসফায়ার, কখনও বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নাম দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হতো। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যেই র্যাব ও পুলিশের হাতে অন্তত ১১ নেতাকর্মী নিহত হন। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন অসংখ্য।
এই তিন কর্মকর্তার মধ্যে কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত হওয়া এই কর্নেল যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকাভুক্ত। বর্তমানে এই তিন কর্মকর্তাই অবসরে। তবে এখন এই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলার প্রস্তুতি চলছে। নিহতদের স্বজনরা ট্রাইব্যুনালে মামলা করবেন।
পারিবারিক সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ঢাকা থেকে শিবিরকর্মী শাহাদাত হোসেনকে আটক করে র্যাব। এরপর তার হাত–পা ভেঙে দিয়ে ১২ মে গভীর রাতে চোখ বেঁধে এনে রাজশাহী নগরীর বিনোদপুরের বেতার মাঠে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নাটক সাজিয়ে শাহাদাতকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর মরদেহ নিতে ফোন করে ডাকা হয় পরিবারকে। বিয়ের মাত্র কবছর পরই স্বামী হারা হন রিনা খাতুন। আর বাবাকে হারিয়ে চিরদিনের জন্য এতিম হয় শাহাদাতের সাড়ে ৪ বছরের শিশুসন্তান।
শাহাদাতের ভাই হাসানুল বান্নার দাবি, তার ভাই জামায়াত–শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এ কারণে র্যাব ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। খবর পেয়ে তারা সেখানে গিয়ে দেখতে পান, আমগাছের নিচে তার ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ পড়ে আছে। খানিকটা দূরে র্যাব অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশের লোকও অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। শাহাদাতের স্ত্রী রিনা খাতুন বলেন, ‘শাহাদাতকে আটকের পর নির্মমভাবে নির্যাতন করেছিল র্যাব। তার দুই হাতের কনুইয়ের হাড় ভেঙে দিয়েছিল। কেবল মাংসের সঙ্গে হাত দুটো ঝুলছিল। গামছা দিয়ে হাত দুটো বাঁধা ছিল। তার পায়ের হাড় কুচি কুচি করে দেওয়া ছিল। মাথায় বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করার কারণে ক্ষত ছিল। শরীরের বিভিন্ন অংশে কোপ দেওয়া ছিল। দুই হাত ও দুই চোখ বেঁধে এনে বেতার মাঠে তাকে হত্যা করে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজায় র্যাব। যারা আমাকে স্বামী হারা করেছে এবং আমার বাচ্চাকে এতিম করেছে, তাদের আমি বিচার চাই।’
এর আগে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি রাজশাহী নগরীর বিনোদপুর ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক ও জামায়াত কর্মী নুরুল ইসলাম শাহীন (৪৫) পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এর আগের দিন নগরীর মালোপাড়ার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পদ্মা অফসেট প্রেস থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে আটক করা হয়। পরদিন নগরীর নলখোলা আশরাফের মোড় এলাকায় তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। নিহত নুরুল ইসলাম শাহীনের স্ত্রী মাসুমা আখতার জানান, আগের দিন রাত ৯টার দিকে শাহীনকে সাদা পোশাকে পুলিশ আটক করে। কিন্তু তাকে আদালতে হাজির করেনি। শাহীনের ছোট ভাই ড. ফজলুল হক তুহিন বলেন, পুলিশ বা র্যাব কাউকে আটকের পর হত্যা করে একই গল্প শোনায়। তাদের এই মিথ্যা গল্প কেউই বিশ^াস করে না। আমার ভাই ছিলেন ব্যবসায়ী, মানবদরদি ও সমাজসেবক। এ কারণে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ হয়তো ভেবেছিল, পরবর্তী সময়ে নির্বাচনে তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারেন। এটা ভেবে প্রশাসনের সহায়তায় তৎকালীন সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের নির্দেশে আমার ভাইকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন তৎকালীন আরএমপি কমিশনার শামসুদ্দিন ও ডিবি পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা। আমরা তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
২০১৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের তথ্য সম্পাদক মোহাম্মাদ শাহাবুদ্দিন। তিনি ক্রপ সায়েন্স বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন। এর আগে ৫ ফেব্রুয়ারি কাটাখালী পৌরসভার এলাকায় সড়ক থেকে মতিহার থানার পুলিশ শাহাবুদ্দিনসহ তিনজনকে আটক করে। পরে গভীর রাতে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে পুলিশ অমানুষিক নির্যাতনের পর তাদের গুলি করে। পরে শাহাবুদ্দিনকে মৃত অবস্থায় এবং অপর দুই শিবির কর্মী হাবিবুর রহমান এবং মফিজুল ইসলামকে পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। ওই সময় মতিহার থানার ওসি ছিলেন আলমগীর হোসেন।
রাজশাহীতে ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল পুলিশের গুলিতে নিহত হন শিবিরকর্মী শহিদুল ইসলাম। তার বাড়ি নগরীর ভাঁড়ালিপাড়ায়। খড়খড়ি বাইপাস সড়কের বড়বনগ্রাম এলাকায় তার গুলিবিদ্ধ লাশ পড়েছিল। হত্যার সময় শহীদুলের তিন বছরের মেয়ে ছিল। এর কয়েকদিন আগে পুলিশ শহিদুলকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তবে গ্রেপ্তারের পর তাকেও আদালতে হাজির করা হয়নি। ছেলেকে হত্যার পর শহীদুলের বাবা শোকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এ ঘটনার কিছুদিন পরই তিনি মারা যান। আর ছেলে হারানোর প্রায় ১০ বছর পরও মা জোসনা বেগমের চোখের পানি শুকায়নি। ছেলের ঘরে গিয়ে প্রতিদিনই নীরবে কাঁদেন।
শহীদুলের প্রসঙ্গ তুলতেই মা জোসনা বেগম কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘শহীদুলের পুুলিশে ধরার খবর পেয়ে আমরা থানায় ও ডিবি পুলিশে রাত–দিন ঘোরাঘুরি করেছি। পুলিশে কথাবার্তায় আমরা বুঝতে পারছিলাম, এখানে আছে শহীদুল। কিন্তু আমাদের বলছে না। দুদিন পর শুনছি বাইপাসের ধারে মেরে ফেলে দিয়ে গেছে। আমার ছেলে খুবই ভালো ছিল। তার অভিযোগ, তৎকালীন আরএমপি কমিশনার মো. শামসুদ্দিনের পরিকল্পনায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তিনি শামসুদ্দিনসহ জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচার চান।
এ ছাড়া রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে ২০১৬ সালে এক জামায়াত কর্মীকে গুমের অভিযোগে গত ২৯ আগস্ট গোদাগাড়ী থানার আমলি আদালতে একটি মামলা হয়েছে। মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গুম হওয়া ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী নাইস খাতুন মামলার বাদী। মামলায় র্যাব–৫ এর তৎকালীন রেলওয়ে কলোনি ক্যাম্পের নায়েক সুবেদার শাহিনুর রহমান, উপপরিদর্শক (এসআই) দেবব্রত মজুমদার, দুলাল মিয়া, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) কামাল হোসেন, ল্যান্স নায়েক মাহিনুর খাতুন, সিপাহি কহিনুর বেগম ও কনস্টেবল মনিরুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে।
রাজশাহী মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি ইমাজউদ্দিন মণ্ডল বলেন, রাজশাহীকে আওয়ামী লীগের জন্য নিরাপদ করতে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ধরে ধরে জামায়াত–শিবিরের নেতাকর্মীদের হত্যার পর কখনও ক্রসফায়ার, কখনও বা বন্দুকযুদ্ধ বলে প্রচার করত র্যাব ও পুলিশ। অনেককে গুমও করা হয়েছে। আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মীকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। এসব নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন র্যাব–৫ এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান এবং আরএমপি কমিশনার এসএম মনির–উজ–জামান ও শামসুদ্দিন। তাদের সময়েই এ ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছে। যারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মামলার প্রস্তুতি চলছে। অনেকেই হয়তো অবসরেও চলে গেছেন। কিন্তু আমরা চাই হত্যাকাণ্ডের বিচার, যাতে পরিবারগুলো ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয়।
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র–আসকের তথ্যমতে, কেবল ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে রাজশাহী বিভাগে ক্রসফায়ারের নামে ১১৬টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।