সুন্দরবন–সংলগ্ন চুনকড়ি নদীতে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে ২০১৭ সালে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ভেটখালী গ্রামের মৃণাল রাজবংশী। তাঁকে হারিয়ে তিন মেয়েকে নিয়ে ‘অথৈ সাগরে’ পড়েন স্ত্রী কল্পনা ধীবর। স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের নিয়ে নদীতে মাছ ধরার কাজে লেগে যান তিনি। ছোট মেয়ে সীমার বয়স তখন ৯ বছর। পরে একে একে বিয়ে দেন মেয়েদের। সর্বশেষ গত ১৬ সেপ্টেম্বর সুন্দরবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সীমাকে পার্শ্ববর্তী উপজেলার চাইলখোলা গ্রামে বিয়ে দেওয়া হয়। সীমা তার শ্বশুরবাড়িতে থাকলেও সেখানে কখনও যাওয়া হয়নি তার মায়ের।
তিন মেয়ের ‘বাল্যবিয়ে’ প্রসঙ্গে কল্পনা বলেন, ‘নদীতে মাছ ধরে, ছুটা (অনিয়মিত) কাজ করে পেট চলত না। ভাইসহ আত্মীয়স্বজন থেকে চেয়েচিন্তে চলতে হতো। বড় মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর জামাইও সাহায্য করে। তা দিয়েও চলা যায় না। প্রতিবেশীরা বললেন, দেশের পরিস্থিতি ভালো না। ভালো পাত্র পাইলে মেয়েরে বিয়ে দিতে। সবার কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে মেয়েদের বিয়ে দিছি।’ সীমার জামাই ইটভাটায় কাজ করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জামাইয়ের বয়স বেশি না। ২১–২২ বছর হবি। বাড়িঘরও যাইনি। মেয়ে–জামাই ওহন কাজ করে খাবি।’ তিনি এলাকায় গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি অন্যদের সহযোগিতা নিয়ে চলবেন বলে জানান।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের রমজাননগর ইউনিয়নের আরিফ হোসেন আবদুল্লাহ স্থানীয় কালিঞ্চি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। স্কুলের খাতায় নাম থাকলেও এখন সে মাছ শিকারি। মা সফুরা খাতুনের সঙ্গে মাছ ধরার পাশাপাশি নৌকা চালিয়ে জীবন চলে তার। “ছেলের বয়স যখন এক বছর, তখনই স্বামী চলে যায়। আবার বিয়ে করে। তখন থেকে উপায় না পেয়ে ‘জনমজুরি’ করছি। মাটি কাটা, ঘেরে ছেল্লা (আবর্জনা পরিষ্কার) দেওয়ার কাজ করতাম। ওহন নদীতে বাগদা পোনা ধরি। নদীতে পোনা না থাকলে ঘেরে সার–তামাক বিছানোর কাজ করি। ছেলেও এখন সাহায্য দেয়।” আরিফের পড়াশোনা বন্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পড়াইলে ভালো হতো। কিন্তু প্রাইভেট দিতি পারি না। ঠিকমতো স্কুল পাঠাতি পারিনি। নদী এলাকায় বাড়ি, গাঙ না পাড়ি দিয়ে স্কুলে যাওয়া যায় না। ওহন ছেলে একবেলা কামলা দিলি ১০০–২০০ টাকা পায়।’ এ ছাড়া তিনি দুপুর ২টা পর্যন্ত কাজ করলে ২৫০ টাকা মজুরি পান বলে জানান।
দারিদ্র্যের কারণে স্কুল ছেড়ে শ্রমে যুক্ত হওয়ার ঘটনা শুধু সীমা ও আরিফের ক্ষেত্রেই নয়, দেশের উপকূলীয় প্রায় সব জেলা ও উপজেলায় এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। অথচ শিশু আইন–২০১৩, জাতীয় শিশু নীতিমালা–২০১১, জাতীয় শিক্ষা নীতিমালা–২০১০, জাতীয় শিশুশ্রম নিরোধ নীতিমালা–২০১০ এবং শিশু অধিকারসংক্রান্ত অন্য বিধিমালা অনুযায়ী সরকারেরই শিশুদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা। বাস্তবে আইন ও নীতিমালা কাগজে–কলমেই আটকে আছে।
সুন্দরবন–সংলগ্ন উপকূলীয় পাঁচ উপজেলায় গিয়ে জানা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা বেড়েছে। এতে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেড়েছে। তা ছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত দারিদ্র্যের কারণেও উপকূলের নারী–পুরুষকে তাদের শিশুদের নিয়ে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে খাদ্য, জ্বালানি ও বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে বেশি শ্রম দিতে হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। অপ্রাপ্ত বয়সী কিশোরীরা প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। জীবন–জীবিকা হুমকির মুখে থাকায় অনেক পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে। অনেকে ঝড়–জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ত পানি বৃদ্ধিতে চাষাবাদের সমস্যা, নদীভাঙনসহ নানা কারণে উপকূলীয় এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বসতি গড়েছেন।
শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার চিত্র
সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, তিন উপকূলীয় উপজেলা আশাশুনি, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগরে ২০২৩ সালে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝরে গেছে কালিগঞ্জে ১৬১ জন। এ ছাড়া শ্যামনগরে ১১২ ও আশাশুনিতে ৩৩ শিক্ষার্থী প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুল ছেড়েছে। তবে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি। সাধারণত সপ্তম থেকে নবম শ্রেণিতে মেয়েদের বিয়ে হয়ে থাকে। আর ছেলেরা মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে বা পরীক্ষায় ফেল করার পর স্কুল ছেড়ে দেয়। প্রতিবছর প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী প্রতিটি উপজেলায় ঝরে যায় বলে গড় হিসাব জানিয়েছেন শিক্ষক ও কর্মকর্তারা।
শ্যামনগর উপজেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে উপজেলার ৪৬টি বিদ্যালয়, ৩৬টি মাদ্রাসা ও তিনটি কারিগরি (ভোকেশনাল) বিদ্যালয়ে ৫ হাজার ৬৫৭ শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিল। ওই বছরের পরীক্ষার্থীরাই ২০২৩ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। তখন এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয় মাত্র ৩ হাজার ২৯৩ জন। অর্থাৎ, ২ হাজার ৩৬৪ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। চলতি বছর শেষে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ২০২৩ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০১৯ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিল ৯২ লাখের বেশি। এ বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮১ লাখ ৬৬ হাজারে। তবে যেসব কলেজে মাধ্যমিক শ্রেণিও পড়ানো হয়, সেগুলোতে শিক্ষার্থী ১ লাখ ৮০ হাজারের মতো বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে উপকূলীয় এলাকার ৮০ ভাগ শিশুই প্রাথমিকের পরে আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমুখী হচ্ছে না বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি ও ডিএম ওয়াচ। গত মার্চে যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ উপকূলের ভোলা, সাতক্ষীরা, বরিশাল ও খুলনার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে নারী–শিশুরা। খুলনা, বরিশালে ৫০ ভাগ হলেও ভোলা ৭৮ ও সাতক্ষীরায় ৬৫ দশমিক ৭ ভাগ নারী–শিশু শ্বাসকষ্টে ভুগছে।
সাম্প্রতিক প্রবণতা
উপকূলীয় এলাকায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার সাম্প্রতিক প্রবণতা প্রসঙ্গে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আয়ুব আলী বলেন, দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার খুব বেশি। কিন্তু দরিদ্র কেন– সেটা খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এখানে ঝড়–জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও খরা লেগে থাকে। মিঠাপানি নেই। লবণাক্ততার কারণে ফসলও তেমন হয় না। এ কারণে স্থানীয়দের মধ্যে নানা অনিশ্চয়তা কাজ করে। এ থেকেই তৃতীয়–চতুর্থ শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় শিশুদের মাছের পোনা সংগ্রহের কাজে লাগানো হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রাইমারির পর আর তারা পড়াশোনা করতে চায় না।
তিনি আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে অভিভাবকদের বুঝিয়ে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক পর্যায়ের ক্লাসে আনা হলেও সেটা কার্যকর হয় না। অধিকাংশ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষার আগে ও পরে ঝরে যায়। অধিকাংশ অভিভাবক মেয়েদের সপ্তম থেকে নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় বিয়ে দেন। মেয়েরাও মাছ ধরে। ছেলেরা মাছ ধরার পাশাপাশি ইটভাটায় কাজ করে।
তিনি জানান, চলতি বছর তাঁর স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৮১ জন ভর্তি হলেও আছে ৬৩ জন, সপ্তম শ্রেণিতে ৬৫ জন থেকে আছে ৪৫, অষ্টম শ্রেণিতে ৬৮ জন থেকে আছে ৪৪, নবম শ্রেণিতে ৪৯ জন থেকে আছে ৩৫ এবং দশম শ্রেণিতে ৩৯ জন থেকে এখন আছে ৩৪ জন। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে এই স্কুল থেকেই ৮২ জন শিক্ষার্থী ঝরে গেছে। এর মধ্যে ৫৭ জন মেয়ে।
শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ির নাইম ইসলাম, আল মামুন, সাব্বির রহমান, মনজরুলসহ অসংখ্য শিশুশ্রমিক এখন ইটভাটায় কাজে যুক্ত। আল হাছান, এমদাদুল হক, আজমীর, মাহফুজ, আবু রায়হান, বর্ষণসহ অনেকে ঘেরে কাজ করছে। তারা সবাই স্কুলশিক্ষার্থী। স্কুলের খাতায় কারও কারও নাম থাকলেও কাজে যুক্ত হয়েছে।
কথা হয় হেতালখালীর আবু রায়হানের সঙ্গে। সে জানায়, তারা দুই ভাইবোন। পরিবারে দাদি ও বাবা–মা আছেন। মাছ ধরে ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসে আয় হয়। দিনে ৫–৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। পাঁচজনে মিলে প্রতিদিন ১০০ থেকে ২০০ কেজি পর্যন্ত মাছ ধরে। মাছ ধরা অনুযায়ী বিক্রির পর প্রতি কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকা হারে কমিশন পেয়ে থাকে।
শ্যামনগর উপজেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি দিনেশ চন্দ্র মণ্ডল বলেন, শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে– এটি প্রশাসনসহ সবাই মেনে নিয়েছে। অভিভাবকদের অসচেতনতা, দরিদ্রতা, জলবায়ুর প্রভাবও দায়ী। সরকার বিনামূল্যে পড়াশোনা এবং বইয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। তবুও শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ধরে রাখা যাচ্ছে না। আগে স্কুলে শিক্ষার্থীদের বিস্কুট দেওয়া হতো। এখন তা বন্ধ। পড়াশোনা ছাড়াও শিশুর অন্য অনেক খরচ আছে, অনেক সমস্যা আছে; সেগুলোর দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।
প্রশাসনের তৎপরতা
শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সাল থেকে গত ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত এই উপজেলায় ৪৭টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরই ১৩টি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ১৪ হাজার বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রনি খাতুন সমকালকে বলেন, উপকূলীয় এলাকায় নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। প্রশাসন শিশুশ্রম বন্ধের পাশাপাশি বাল্যবিয়ে রোধে ভূমিকা রাখছে। এ–সংক্রান্ত তথ্য পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে এ সমস্যা সমাধানে সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতনতাও জরুরি। শুধু প্রশাসনের পক্ষে সমস্যার সমাধান করা দুরূহ।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিষয়টি আমাদের নজরেও এসেছে। জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সব শিক্ষা কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এতে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।
বিশিষ্ট আইনজীবী জেড আই খান পান্না সমকালকে বলেন, উপকূলীয় এলাকাসহ প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের অবস্থা শোচনীয়। এর মূল কারণ অর্থনীতি। সরকারের অধিকাংশ কর্মকাণ্ড ঢাকাকেন্দ্রিক এবং সচিবালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে দরিদ্র, হতদরিদ্র মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাষ্ট্রকে অবশ্যই আইন অনুযায়ী শিশুদের দায়িত্ব নিতে হবে। শিশুদের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে থাকবে– এটি মেনে নেওয়া যায় না।