পরিপাটি বেশবাসে মোহামেডান ক্লাবের আমতলায় দেখা যায়নি অনেক দিন। শরীর ভালো ছিল না তাঁর। প্রতাপ শঙ্কর হাজরাকে নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার দিন ফুরিয়েছিল আগেই। গতকাল মানিকজোড়ের বিচ্ছেদ চিরতরে। কারণ জাকারিয়া পিন্টু পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা জাকারিয়া পিন্টু বাংলাদেশ ফুটবলেরও প্রথম অধিনায়ক। কিংবদন্তি এই বীর ফুটবলারের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ক্রীড়া সম্পাদক ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক শোক প্রকাশ করেন।
রোববার বিকেলে অসুস্থ পিন্টুকে শঙ্করের ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় সিসিইউতে রাখা হয়েছিল তাঁকে। বিপক্ষ দলের ফরোয়ার্ডের সামনে প্রতিরোধের দেয়াল হয়ে দাঁড়ানো ‘কিং ডিফেন্ডার’ জীবনের লড়াইয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি সিসিইউতে। গতকাল দুপুর পৌনে ১২টায় সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক পিন্টু এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক ছিলেন। ছিলেন দেশের ফুটবল ভক্তদের নায়ক। ফুটবলে কত স্মৃতি তাঁর! তিনি জন্মেছিলেন অধিনায়ক হওয়ার জন্যই। জাতীয় দল, ক্লাব ফুটবল– সবখানেই ছিলেন নেতৃত্বে। তাই কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেছেন, ‘তিনি আমার অধিনায়ক।’ প্রতাপ শঙ্কর হাজরার কাছে কিং ডিফেন্ডার। কিংবদন্তি এ ফুটবলারকে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে। আজ সকাল ১০টায় মোহামেডান ক্লাবে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন ও প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জোহরের নামাজের পর জাতীয় প্রেস ক্লাবে হবে দ্বিতীয় জানাজা। কারণ তিনি ছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য। ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, বাফুফে সভাপতি, বিসিবি সভাপতি, মোহামেডান ক্লাব, বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতিসহ দেশের ক্রীড়া ফেডারেশনগুলো শোক বার্তা দিয়েছে।
১৯৪৩ সালের ১ জানুয়ারি নওগাঁ জেলায় জাকারিয়া পিন্টুর জন্ম। শৈশব, কৈশোর কেটেছে বরিশালে। স্কুল ও কলেজ দলের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান দলের ডিফেন্ডার। পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলেন ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের মাটিতে নেতৃত্ব দেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে। প্রবাসী সরকারের জন্য তহবিল সংগ্রহের পাশাপাশি স্বাধীনতার পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তুলতে ফুটবল নিয়ে লড়াই করেছিলেন তারা। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ৩৩ জন খেলোয়াড়ের অধিনায়ক তিনি। নিজেকে কখনও সাবেক অধিনায়ক বলতেন না। কারণ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের দ্বিতীয় কোনো অধিনায়ক নেই। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে নদিয়া একাদশের বিপক্ষে প্রথম প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। ম্যাচের আগে জাতীয় পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করে ফুটবলাররা সাড়া ফেলে দেন। প্রথম প্রীতি ম্যাচটি ২–২ গোলে ড্র হয়েছিল। ৮ আগস্ট কলকাতায় মোহনবাগানের খ্যাতনামা ফুটবলার গোষ্ঠ পালের নামে গড়া দলের বিপক্ষে খেলেন পরের ম্যাচ। এভাবে ভারতে বিভিন্ন জায়গায় ১৬টি ম্যাচ খেলে জনমত গড়ে তোলেন জাকারিয়া পিন্টুরা। শেষ ম্যাচ খেলেন মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে। মহারাষ্ট্র ফুটবল দলের নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক ক্রিকেটার মনসুর আলি খান পোতৌদি। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ১২টি ম্যাচ জিতে সাড়ে ৩ লাখ রুপি প্রবাসী সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিল। জাকারিয়া পিন্টুর স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নিয়ে ১৯ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে। বরিশালের এ ফুটবলার ব্যক্তিজীবনে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৮ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার ও ১৯৯৫ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তাঁকে।