ধর্ম হলো আধ্যাত্ববাদ আর যিনি সেই আধ্যাত্ববাদে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, প্রকৃত ধার্মিকের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে পেরেছেন, তিনি তো আর কোনো ভিন্ন চরিত্র বা মনমানসিকতার সাথে একাকার হতে পারেন না। তিনি হয়ে গেছেন খোদার অবিকল প্রতিচ্ছবি যার মাধ্যমে ধর্মের অনুসন্ধানী ব্যক্তিবর্গ ধর্মের ইতিবৃত্ত সহজেই খুঁজে নিতে পারে। বাস্তবে প্রকৃত ধার্মিকতার কোনো বাহ্যিক বাহারি চিহ্ন থাকার কথা নয়। কেননা, ধর্ম হলো হৃদয়ের বিষয়, রূহের অধিকার দেহের বা পোশাকের ব্যবহার বা ফালতু বিষয় নয়; যেমন গায়ে রামাবলি জড়িয়ে ব্যক্তিকে ধর্মপ্রাণ বলে চিহ্নিত করতে চাচ্ছেন? পাজামা–পাঞ্জাবী টুপি–পাগড়ী দিয়ে কিসের পরিচয় ঘটাতে চান? গোটা বিশ্বে খোদা হলেন একমাত্র ধার্মিক, আর তিনি স্বীয় পাকরূহকে মানবরূপে প্রেরণ করেছেন যেন গোটাবিশ্ব ধার্মিকতার তথা খোদার অবিকল প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়; যার অর্থ হলো শতভাগ ধার্মিক হিসেবে মাটির মানুষ তাকে প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে অদৃশ্য খোদাকে দেখে খোদাই পথ স্বভাব আচরণ অনুধাবণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। মানুষ বরাবর গুনাহগার। আদম থেকে শুরু করে সকলে পাপ করেছে এবং খোদাকে অস্বীকার করেছে। খোদার প্রকৃত পথ, সত্য ও জীবন অবলোকন করার সুযোগ থেকে তারা হয়ে পড়েছে খারিজ।
খুন, রাহাজানি করাটা কোন ধর্মের শর্ত বলে মেনে নিবেন। বর্তমান বিশ্বে পাপ পূণ্যের জগাখিচুড়ি সাধারণ আনপড় ব্যক্তিদের অত্যাবশ্যক খাদ্য হিসেবে পরিবেশন করা হচ্ছে। যিনি খোদার প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তি তার সাথেও পরিচয় ঘটাতে ইবলিসাশ্রীত ধোঁকাবাজদের দল মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করে চলছে। ভ্যাজালের বিশ্বে সাধুসন্ত আর প্রতারক মনস্তাত্বিক, ওজর আপত্তি তুলে সাধারণ একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে, আর তা কেবল বাহুবলের দ্বারাই কার্যকর করে আসছে, বিধিদানকারী সমাজ নিজেদের এমন বধৌদ্যত প্রস্তুতি নিয়ে বিরুদ্ধাবাদী যাকে সে অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে সেখানেই খতম করার ঐশি আইন বাস্তবায়ন করে চলছে। আর মনের এমন অবস্থাকে ধার্মিকতার নজীর হিসেবে প্রচার প্রসার ঘটিয়ে আসছে সেই আদিকাল থেকে।
মানব সমাজে প্রথম খুনি হলো আদম পুত্র কাবিল যে কিনা পার্থীব স্বার্থে স্বীয় সহোদর ভ্রাতা হাবিলকে প্রান্তরে বধ করে বসলো। তারপরে সমাজে ধর্মের অজুহাতে কত লক্ষকোটি প্রাণ যে অকালে বলিকৃত হয়ে আসছে, তার হিসেব কি আপনাদের জানা আছে? তা আর্থ অনার্থ বলুন, বৈদিক সভ্যতার কথাই বলুন, প্রাক ইসলামের যুগের কথা বলুন, প্রত্যেকটা ইতিহাস বা সভ্যতা বিরচিত হয়েছে কেবল মানুষের রক্তে। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এসে সমাজে কি কি ঘটনা ঘটেছে ইতিহাসের ঐসকল পাতা ভালো করে পাঠ করুন, সুযোগ পেলে বিশ্লেষণ করুন, তবে তুলনা মূলকভাবে আলোচনা হলে প্রকৃত সত্য ঘটনাপুঞ্জি বেরিয়ে আসবে। কালামপাাক থেকে দু’টি অংশ তুলে ধরার প্রয়াশ নিচ্ছি। ধৈর্যসহ পাঠ করে এর মর্মার্থ জেনে নিন। “সৃষ্টির শুরুতেই আল্লাহ আসমান ও জমীন সৃষ্টি করলেন। দুনিয়ার উপরটা তখনও কোন বিশেষ আকার পায় নি, আর তার মধ্যে জীবন্ত কিছুই ছিল না; তার উপরে ছিল অন্ধকারে ঢাকা গভীর পানি। আল্লাহর রূহ সেই পানির উপরে চলাফেরা করছিলেন। আল্লাহ বললেন, “আলো হোক।”আর তাতে আলো হল। তিনি দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। তিনি অন্ধকার থেকে আলোকে আলাদা করে আলো নাম দিলেন দিন আর অন্ধকারের নাম দিলেন রাত। এভাবে সন্ধ্যাও গেল সকালও গেল, আর সেটাই ছিল প্রথম দিন। তারপর আল্লাহ বললেন, “পানির মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হোক, আর তাতে পানি দু’ভাগ হয়ে যাক।” এভাবে আল্লাহ পানির মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি করলেন এবং নীচের পানি ও উপরের পানি আলাদা করলেন। তাতে উপরের পানি ও নীচের পানি আলাদ হয়ে গেল। আল্লাহ যে ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি করেছিলেন তার নাম তিনি দিলেন আসমান। এভাবে সন্ধ্যাও গেল সকালও গেল, আর সেটাই ছিল দ্বিতীয় দিন। এরপর আল্লাহ বললেন, “আসমানের নীচের সব পানি এক জায়গায় জমা হোক এবং শুকনা জায়গা দেখা দিক।” আর তা–ই হল। আল্লাহ সেই শুকনো জায়গার নাম দিলেন ভূমি, আর সেই জমা হওয়া পানির নাম দিলেন সমুদ্র। আল্লাহ দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। তারপর আল্লাহ বললেন, “ভূমির উপরে ঘাস গজিয়ে উঠুক; আর এমন সব শস্য ও শাক–সবজীর গাছ হোক যাদের নিজের নিজের বীজ থাকবে। ভূমির উপর বিভিন্ন জাতের ফলের গাছও গজিয়ে উঠুক যেগুলোতে তাদের নিজের নিজের ফল ধরবে; আর সেই সব ফলের মধ্যে থাকবে তাদের নিজের নিজের বীজ।” আর তা–ই হল। ভূমির মধ্যে ঘাস, নিজের বীজ আছে এমন সব বিভিন্ন জাতের শস্য ও শাক–সবজীর গাছ এবং জাতের ফলের গাছের জন্ম হল; আর সেই সব ফলের মধ্যে তাদের নিজের নিজের বীজ ছিল। আল্লাহ দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। এভাবে সন্ধ্যাও গেল সকালও গেল, আর সেটাই ছিল তৃতীয় দিন। তারপর আল্লাহ বললেন, “আসমানের মধ্যে আলো দেয় এমন সব কিছু দেখা দিক, আর তা রাত থেকে দিনকে আলাদা করুক। সেগুলো আলাদা আলাদা দিন, ঋতু আর বছরের জন্য চিহ্ন হয়ে থাকুক। আসমান থেকে সেগুলো দুনিয়ার উপর আলো দিক।” আর তা–ই হল। আল্লাহ দু’টা বড় আলো তৈরী করলেন। তাদের মধ্যে বড়টিকে দিনের উপর রাজত্ব করবার জন্য, আর ছোটটিকে রাতের উপর রাজত্ব করবার জন্য তৈরী করলেন। তা ছাড়া তিনি তারাও তৈরী করলেন। তিনি সেগুলোকে আসমানের মধ্যে স্থাপন করলেন যাতে সেগুলো দুনিয়ার উপর আলা দেয়, দিন ও রাতের উপর রাজত্ব করে আর অন্ধকার থেকে আলোকে আলাদা করে রাখে। আল্লাহ দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। এভাবে সন্ধ্যাও গেল সকালও গেল, আর সেটাই ছিল চতুর্থ দিন। তারপর আল্লাহ বললেন, “পানি বিভিন্ন প্রাণীর ঝাঁকে ভরে উঠুক, আর দুনিয়ার উপরে আসমানের মধ্যে বিভিন্ন পাখী উড়ে বেড়াক।” এভাবে আল্লাহ সমুদ্রের বড় বড় প্রাণী এবং পানির মধ্যে ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ানো বিভিন্ন জাতের প্রাণী সৃষ্টি করলেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন জাতের পাখীও সৃষ্টি করলেন। তাদের প্রত্যেকের নিজের নিজের জাতি অনুসারে বংশ বৃদ্ধি করবার ক্ষমতা রইল। আল্লাহ দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। আল্লাহ তাদের এই বলে দোয়া করলেন, “বংশবৃদ্ধির ক্ষমতায় পূর্ণ হয়ে তোমরা নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলো, আর তা দিয়ে সমুদ্রের পানি পূর্ণ কর। দুনিয়ার উপরে পাখীরাও নিজের নিজের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলুক।” এভাবে সন্ধ্যাও গেল সকালও গেল, আর সেটাই ছিল পঞ্চম দিন। তারপর আল্লাহ বললেন, “মাটি থেকে এমন সব প্রাণীর জন্ম হোক যাদের নিজের নিজের জাতকে বাড়িয়ে তুলবার ক্ষমতা থাকবে। তাদের মধ্যে গৃহপালিত, বন্য ও বুকে–হাঁটা প্রাণী থাকুক।” আর তা–ই হল। আল্লাহ দুনিয়ার সব রকমের বন্য গৃহপালিত এবং বুকে–হাঁটা প্রাণী সৃষ্টি করলেন। এদের সকলেরই নিজের নিজের জাতকে বাড়িয়ে তুলবার ক্ষমতা রইল। আল্লাহ দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। তারপর আল্লাহ বললেন, “আমরা আমাদের মত করে এবং আমাদের সংগে মিল রেখে এখন মানুষ তৈরী করি। তারা সমুদ্রের মাছ, আকাশের পাখী, পশু, বুকে–হাঁটা প্রাণী এবং সমস্ত দুনিয়ার উপর রাজত্ব করুক।” পরে আল্লাহ তাঁর মত করেই মানুষ সৃষ্টি করলেন। হ্যাঁ তিনি তাঁর মত করেই মানুষ সৃষ্টি করলেন, সৃষ্টি করলেন পুরুষ ও স্ত্রীলোক করে। আল্লাহ তাঁদের দোয়া করে বললেন, “তোমরা বংশবৃদ্ধির ক্ষমতায় পূর্ণ হও, আর নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে দুনিয়া ভরে তোলো এবং দুনিয়াকে নিজেদের শাসনের অধীনে আন। এছাড়া তোমরা সমুদ্রের মাছ, আকাশের পাখী এবং মাটির উপর ঘুরে বেড়ানো প্রত্যেকটি প্রাণীর উপরে রাজত্ব কর।” এরপরে আল্লাহ বললেন, “দেখ, দুনিয়ার উপরে প্রত্যেকটি শস্য ও শাক–সবজী যার নিজের বীজ আছে এবং প্রত্যেকটি গাছ যার ফলের মধ্যে তার বীজ রয়েছে সেগুলো আমি তোমাদের দিলাম। এগুলোই তোমাদের খাবার হবে। দুনিয়ার উপরের প্রত্যেকটি পশু, আসমানের প্রত্যেকটি পাখি এবং বুকে–হাঁটা প্রত্যেকটি প্রাণী, এক কথায় সমস্ত প্রাণীর খাবারের জন্য আমি সমস্ত শস্য ও শাক–সবজী দিলাম।” আর তা–ই হল। আল্লাহ তাঁর নিজের তৈরী সব কিছু দেখলেন। সেগুলো সত্যিই খুব চমৎকার হয়েছিল। এভাবে সন্ধ্যাও গেল সকালও গেল, আর সেটাই হল ষষ্ঠ দিন” (পয়দায়েশ ১ : ১–৩১), আর একটি অংশ ধরছি, “প্রথমেই কালাম ছিলেন, কালাম আল্লাহর সংগে ছিলেন এবং কালাম নিজেই আল্লাহ ছিলেন। আর প্রথমেই তিনি আল্লাহর সংগে ছিলেন। সব কিছুই সেই কালামের দ্বারা সৃষ্ট হয়েছিল, আর যা কিছু সৃষ্ট হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে কোন কিছুই তাঁকে ছাড়া সৃষ্ট হয় নি। ৪ তাঁর মধ্যে জীবন ছিল এবং সেই জীবনই ছিল মানুষের নূর। সেই নূর অন্ধকারের মধ্যে জ্বলছে কিন্তু অন্ধকার নূরকে জয় করতে পারে নি। আল্লাহ ইয়াহিয়া নামে একজন লোককে পাঠিয়েছিলেন। তিনি নূরের বিষয়ে সাক্ষী হিসাবে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন যেন সকলে তাঁর সাক্ষ্য শুনে ঈমান আনতে পারে। তিনি নিজে সেই নূর ছিলেন না কিন্তু সেই নূরের বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। সেই আসল নূর, যিনি প্রত্যেক মানুষকে নূর দান করেন, তিনি দুনিয়াতে আসছিলেন। তিনি দুনিয়াতেই ছিলেন এবং দুনিয়া তাঁরা দ্বারা সৃষ্ট হয়েছিল, তবু দুনিয়ার মানুষ তাঁকে চিনল না। তিনি নিজের দেশে আসলেন, কিন্তু তাঁর নিজের লোকেরাই তাঁকে গ্রহণ করল না। তবে যতজন তাঁর উপর ঈমান এনে তাঁকে গ্রহণ করল তাদের প্রত্যেককে তিনি আল্লাহর সন্তান হবার অধিকার দিলেন। এই লোকদের জন্ম রক্ত থেকে নি, শারীরিক কামনা বা পুরুষের বাসনা থেকেও হয় নি, কিন্তু আল্লাহ থেকেই হয়েছে।” (ইউহোন্না ১ : ১–১৩)।
মানবশ্রষ্টা খোদা হলেন ক্ষমা ও মহব্বতের খোদা। তিনি গুনাহগার বিশ্বটাকে এতটাই মহব্বত করেছেন যা হিসেব নেওয়া কোনো মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা আদৌ সম্ভব নয়। মানুষের পাপের কাফফারা পরিশোধ করার জন্য এবং নয়নের মণিতুল্য সন্তানদের স্বীয় ক্রোড়ে ফিরিয়ে নেবার জন্য স্বীয় কালাম ও পাকরূহ মানব শিশুরূপে জগতে প্রেরণ করেছেন। তিনি হলেন ঐশি মেষ, কালেমাতুল্লাহ, যার কাছে ভরসা পায় সকল অনুতপ্ত গুনাহগার বান্দাহ। মানুষের গুনাহের বোঝা বহন করার জন্য যোগ্য নিষ্পাপ মেষ হলেন খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসীহ যিনি সম্পূর্ণ নিষ্পাপ, তাঁর বিষয়ে দুষ্টের দল ভ্রান্ত আজগুবী মতবাদ প্রচার করে সাধারণ জনমানুষকে ভ্রান্ত করে রেখেছে।
যে ব্যক্তি মানুষ খুন করেছে তেমন জিঘাংসা কাতর ব্যক্তির আসপাস থেকে আমাদের অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে। বিশ্বে সর্বপ্রথম প্রতারক মানুষের ক্ষতিকারক ব্যক্তির পরিচয় কি আপনাদের জানা আছে? প্রতারণার মাধ্যমে আদম জাতিকে উক্ত ইবলিস খোদাদ্রোহী করে রেখেছে। অভিশপ্ত ইবলিস ব্যতিত আর কে হতে পারে বলুন! মানুষের ধ্বংসের মূল নায়ক হলো অভিশপ্ত ইবলিস। ইবলিসকে পরিষ্কারভাবে চিনে নেবার উপায় হলো, প্রতারণা, ধোকা, মধুর সাথে হলাহল মিশ্রণ। আপনি কাউকে প্রেম করবেন আবার তাকে গর্দ্দানে আঘাত দিয়ে মুন্ডপাত ঘটাবেন, এমন উদ্ভুট মন্ত্রণা খোদার কালামে কেউ কি প্রত্যাশা করতে পারে? যদি ধর্ম ব্যক্তিকে ধার্মিক হিসেবে রূপান্তরিত করার সেই প্রাথমিক পরিকল্পনা বহুপূর্বেই বানচাল হয়ে গেছে। ধর্ম আজ পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক কর্মকান্ড তথা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠিকে পরাধীন করে রাখার নিমিত্তে যা ধর্ম নামের শুরু থেকে প্রত্যক্ষ করে আসছি। যদিও খোদার হুকুম আহকাম জারী হয়েছে অন্ধকারের রাজ্য থেকে মানুষটিকে অবমুক্ত করার জন্য। খোদা নিজেই হলেন প্রেম, আর সেই ঐশি প্রেমের প্রাঞ্জল প্রকাশ ঘটিয়েছে খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসীহ। খোদা বিশ্বের পাপের কাফফারা স্বীয় পূতপবিত্র প্রাণের দামে পরিশোধ করেছেন। প্রেমের দিকপাশ গভীরতা যে কতোটা ব্যাপক তা আমরা দেখতে পাই মসীহের আত্মকোরবানির মাধ্যমে।
কিতাব থেকে মহব্বত সম্বন্ধে একটি অধ্যায় তুলে দেবার প্রয়াশ নিচ্ছি। আশা করি পাঠককুল বিষয়টির গভীরতা অনুধাবন করতে সহায়ক হবে। “আমি যদি মানুষের এবং ফেরেশতাদের ভাষায় কথা বলি কিন্তু আমার মধ্যে মহব্বত না থাকে, তবে আমি জোরে বাজানো ঘণ্টা বা ঝনঝন করা করতাল হয়ে পড়েছি। যদি নবী হিসাবে কথা বলবার ক্ষমতা আমার থাকে, যদি আমি সমস্ত গোপন সত্যের বিষয় বুঝতে পারি, আর যদি আমার সব রকম জ্ঞান থাকে, এমন কি, পাহাড়কে পর্যন্ত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে দেবার মত পূর্ণ বিশ্বাস থাকে, কিন্তু আমার মধ্যে মহব্বত না থাকে, তবে আমার কোনই মূল্য নেই। আমার যা কিছু আছে তা যদি আমি গরীবদের খাওয়াবার জন্য দান করি, এমন কি, শরীরটাও পোড়াবার জন্য দিয়ে দিই, কিন্ত আমার মধ্যে যদি মহব্বত না থাকে, তবে আমার কোনই লাভ নেই। মহব্বত সময় ধৈর্য ধরে, দয়া করে, হিংসা করে না, গর্ব করে না, অহংকার করে না, খারাপ ব্যবহার করে না, নিজের সুবিধার চেষ্টা করে না, রাগ করে না, কারও খারাপ ব্যবহারের কথা মনে রাখে না, খারাপ কিছু নিয়ে আনন্দ করে না বরং যা সত্য তাতে আনন্দ করে। মহব্বত সব কিছুই সহ্য করে, সকলকেই বিশ্বাস করতে আগ্রহী, সব কিছুতে আশা রাখে আর সব অবস্থায় স্থির থাকে। এই মহব্বত কখনও শেষ হয় না। নবী হিসাবে কথা বলবার যে ক্ষমতা আছে তা শেষ হয়ে যাবে; বিভিন্ন ভাষায় কথা বলবার যে ক্ষমতা আছে তা চলে যাবে; জ্ঞান আছে, তাও শেষ হয়ে যাবে; কারণ আমরা সব বিষয় পুরোপুরি ভাবে জানি না, নবী হিসাবেও পুরোপুরি ভাবে কথা বলতে পারি না। কিন্তু যা পূর্ণ তা যখন আসবে তখন যা পূর্ণ নয় তা শেষ হয়ে যাবে। আমি যখন শিশু ছিলাম তখন শিশুর মত কথা বলতাম, শিশুর মত চিন্তা করতাম আর শিশুর মত বিচারও করতাম। এখন আমার বয়স হয়েছে, তাই শিশুর আচার–ব্যবহারগুলো বাদ দিয়েছি। আমরা এখন যেন আয়নায় অস্পষ্ট দেখছি, কিন্তু তখন সামনা–সামনি দেখতে পাব। আমি এখন যা জানি তা অসম্পূর্ণ, কিন্তু আল্লাহ আমাকে যেমন সম্পূর্ণভাবে জানেন তখন আমি তেমনি সম্পূর্ণভাবে জানতে পারব। তাহলে দেখা যাচ্ছে বিশ্বাস, আশা আর মহব্বতÑ এই তিনটিই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে; কিন্তু এগুলোর মধ্যে মহব্বতই সবচেয়ে বড়” (১করিন্থীয় ১৩ : ১–১৩)।
যদিও বর্তমান বিশ্ব পরিণত হয়ে আছে পরিষ্কার নরকপুরীতে, তারপরেও মানুষ বেঁচে আছে; কথায় বলে, যতক্ষণ স্বাস ততক্ষণ আশ। গুনাহগার ব্যক্তিদের জন্য ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের পথে ফিরে আসার অনুতাপ অনুশোচনা করার একমাত্র সুযোগ তার জীবদ্দশায়। দেহ থেকে প্রাণবায়ু বের হবার পরে ব্যক্তির আর কিছুই করার থাকবে না। তবে লাসার নামক মসীহের এক বন্ধুকে মৃত্যুর চার দিন পরে জীবিত করে তুলে প্রমাণ দিলেন কেবল মসীহের পক্ষেই সম্ভব মৃতকে জীবন দান করা। কিতাবের আলোকে আর একটি ঘটনা দেখতে পাই। শুকনা হাড়ের উপত্যাকা। “মাবুদের হাত আমার উপরে ছিল এবং তিনি তাঁর রূহের দ্বারা আমাকে নিয়ে গিয়ে একটা উপত্যকার মাঝখানে রাখলেন; জায়গাটা হাড়গোড়ে ভরা ছিল। তিনি সেগুলোর চারপাশ দিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন। আমি সেই উপত্যকার মধ্যে অনেক হাড়গোড় দেখলাম; সেগুলো ছিল খুব শুকনা। ৩তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে মানুষের সন্তান, এই হাড়গুলো কি বেঁচে উঠতে পারে?” আমি বললাম, “হে আল্লাহ্ মালিক, তুমিই কেবল তা জান।” তখন তিনি আমাকে সেই হাড়গুলোর কাছে এই ভবিষ্যদ্বাণী বলতে বললেন, “ওহে শুকনা সব হাড়, তোমরা মাবুদের কালাম শোন। আল্লাহ্ মালিক বলছেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে নিঃশ্বাস ঢুকিয়ে দেব আর তোমরা জীবিত হবে। আমি তোমাদের হাড়ের সংগে হাড় বেঁধে দেব, তোমাদের উপরে গোশ্ত জন্মাব এবং চামড়া দিয়ে তা ঢেকে দেব। আমি তোমাদের মধ্যে নিঃশ্বাস দেব আর তোমরা জীবিত হবে। তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ।’ ” আমাকে যেমন হুকুম দেওয়া হয়েছিল আমি তখন সেইমতই ভবিষ্যদ্বাণী বললাম। ভবিষ্যদ্বাণী বলবার সময় খট্খট্ শব্দ হতে লাগল এবং হাড়গুলোর প্রত্যেকটা নিজের নিজের হাড়ের সংগে যুক্ত হল। আমি দেখলাম হাড়ের সংগে হাড়ের বাঁধন হল, তার উপরে গোশ্ত হল এবং চামড়া দিয়ে তা ঢাকা পড়ল, কিন্তু তাদের মধ্যে শ্বাস ছিল না। তখন তিনি আমাকে বললেন, “তুমি বাতাসের উদ্দেশে ভবিষ্যদ্বাণী বল; হে মানুষের সন্তান, তুমি এই ভবিষ্যদ্বাণী বল যে, আল্লাহ্ মালিক বলছেন, ‘হে বাতাস, তুমি চারদিক থেকে এস এবং এই সব নিহত লোকদের মধ্যে শ্বাস দাও যাতে তারা জীবিত হয়।’ ” সেইজন্য তাঁর হুকুমমতই আমি ভবিষ্যদ্বাণী বললাম আর তখন তাদের মধ্যে শ্বাস ঢুকল; তারা জীবিত হয়ে পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারা ছিল এক বিরাট সৈন্যদল। তারপর তিনি আমাকে বললেন, “হে মানুষের সন্তান, এই হাড়গুলো হল গোটা ইসরাইল জাতি। তারা বলছে, ‘আমাদের হাড়গুলো শুকিয়ে গেছে আর আমাদের আশাও চলে গেছে; আমরা মরে গেছি।’ কাজেই তুমি তাদের কাছে এই ভবিষ্যদ্বাণী বল যে, আল্লাহ্ মালিক বলছেন, ‘হে আমার বান্দারা, আমি তোমাদের কবর খুলে সেখান থেকে তোমাদের তুলে আনব। ইসরাইল দেশে আমি তোমাদের ফিরিয়ে আনব। আমি যখন তোমাদের কবর খুলে সেখান থেকে তোমাদের বের করে আনব তখন তোমরা জানবে যে, আমিই মাবুদ। আমার রূহ্ আমি তোমাদের মধ্যে দেব এবং তোমরা জীবিত হবে। তোমাদের নিজেদের দেশে আমি তোমাদের বাস করাব। তখন তোমরা জানবে যে, আমি মাবুদই এই কথা বলেছি এবং তা করেছি।’ ” পরে মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাজেল হল, “হে মানুষের সন্তান, একটা লাঠি নিয়ে তুমি তার উপর এই কথা লেখ, ‘এহুদা ও তার সংগের বনি–ইসরাইলদের জন্য।’ তারপর আর একটা লাঠি নিয়ে তার উপরে লেখ, ‘আফরাহীমের লাঠি, অর্থাৎ ইউসুফ ও তার সংগের সমস্ত বনি–ইসরাইলদের জন্য।’ পরে সেই দু’টা লাঠি জোড়া দিয়ে একটা লাঠি বানাও যাতে তোমার হাতে সেই দু’টা একটা লাঠিই হয়। “তোমার জাতির লোকেরা যখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করবে, ‘তুমি কি এর মানে আমাদের বলবে না?’ তখন তুমি তাদের বলবে যে, আল্লাহ্ মালিক বলছেন, ‘আফরাহীমের হাতে ইউসুফ ও তার সংগের ইসরাইলের গোষ্ঠীগুলোর যে লাঠিটা আছে আমি সেটা নিয়ে এহুদার লাঠির সংগে জোড়া দিয়ে একটা লাঠিই বানাব আর সেই দু’টা আমার হাতে একটাই হবে।’ তুমি যে লাঠি দু’টার উপর লিখেছ তা তাদের চোখের সামনে তুলে ধরে তাদের বলবে যে, আল্লাহ্ মালিক বলছেন, ‘বনি–ইসরাইলরা যে সব জাতিদের মধ্যে আছে সেখান থেকে আমি তাদের বের করে আনব। আমি চারদিক থেকে তাদের জড়ো করে তাদের নিজেদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। সেখানে ইসরাইলের পাহাড়–পর্বতের উপরে আমি তাদের নিয়ে একটাই রাজ্য করব। তাদের সকলের উপরে একজনই বাদশাহ্ হবে এবং তারা আর কখনও দুই হবে না কিংবা দু’টা রাজ্যে ভাগ হবে না। তাদের সব প্রতিমা, মূর্তি কিংবা তাদের কোন অন্যায় দিয়ে তারা আর নিজেদের নাপাক করবে না। তাদের সব গুনাহ্ ও বিপথে যাওয়া থেকে আমি তাদের রক্ষা করব এবং পাক–সাফ করব। তারা আমার বান্দা হবে এবং আমি তাদের আল্লাহ্ হব। “‘আমার গোলাম দাউদ তাদের বাদশাহ্ হবে এবং তাদের সকলের পালক একজনই হবে। তারা আমার শরীয়ত মতে চলবে এবং আমার সব নিয়ম সতর্ক হয়ে পালন করবে। যে দেশ আমি আমার গোলাম ইয়াকুবকে দিয়েছি, যে দেশে তাদের পূর্বপুরুষেরা বাস করে গেছে সেখানেই তারা বাস করবে। তারা, তাদের ছেলেমেয়েরা ও নাতী–নাতনীরা সেখানে চিরকাল বাস করবে এবং আমার গোলাম দাউদ চিরকাল তাদের বাদশাহ্ হবে। আমি তাদের জন্য একটা শান্তির ব্যবস্থা স্থাপন করব; সেটা হবে একটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা। আমি তাদের শক্তিশালী করব ও তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেব এবং আমার ঘর আমি চিরকালের জন্য তাদের মধ্যে স্থাপন করব। আমার বাসস্থান হবে তাদের মধ্যে; আমি তাদের আল্লাহ্ হব এবং তারা আমার বান্দা হবে। আমার ঘর যখন চিরকালের জন্য তাদের মধ্যে হবে তখন জাতিরা সব জানবে যে, আমি মাবুদই ইসরাইলকে পবিত্র করেছি।’” (ইহিস্কেল ৩৭ : ১–২৮)।
পাককালামের আলোকে খোদা বারবার পরম আশাব্যঞ্জক বাণী জারি করে রেখেছেন। যেমন আইস আমরা উক্ত প্রতুত্তর করি। “মাবুদ আরও বলছেন, “এখন এস, আমরা বোঝাপড়া করি। যদিও তোমাদের সব গুনাহ্ টক্টকে লাল হয়েছে তবুও তা বরফের মত সাদা হবে; যদিও সেগুলো গাঢ় লাল রংয়ের হয়েছে তবুও তা ভেড়ার লোমের মত সাদা হবে।” (ইশাইয়া ১ : ১৮) “তখন আমার লেঅকেরা, যাদে আমার বান্দা বলে ডাকা হয় তারা যদি ন¤্র হয়ে মুনাজাত করে ও আমার রহমত চায় এবং খারাপ পথ থেকে ফেরে, তবে বেহেশত থেকে তা শুনে আমি তাদের গুনাহ মাফ করব এবং তাদের দেশের অবস্থা ফিরিয়ে দেব” (২খান্দাননামা ৭ : ১৪), “সন্তান আমার, মসীহ ঈসা রহমতে তুমি শক্তিশালী হও। অনেক সাক্ষীর সামনে আমার মুখে যে সব শিক্ষার কথা তুমি শুনেছ সেই শিক্ষা ধরে রাখবার জন্য তুমি তা এমন সব বিশ্বস্ত লোকদের দাও যাদের অন্যদের শিক্ষার যোগ্যতা আছে। মসীহ ঈসার একজন উপযুক্ত সৈনিকের মত তুমি আমাদের সংগে কষ্ট সহ্য কর। যুদ্ধ করতে গিয়ে কেউ সংসারের মধ্যে নিজেকে জড়ায় না, যেন সৈন্য হিসাবে যিনি তাকে ভর্তি করেছে তাঁকে সে সন্তুষ্ট করতে পারে। তেমনি করে প্রতিযোগীতার খেলায় যোগ দিয়ে কেউ যদি নিয়ম মত না খেলে তবে সে জয়ের মালা পায় না। যে চাষী পরিশ্রম করে তারই প্রথমে ফসলের ভাগ পাওয়া উচিত। আমি যা বলছি তা তুমি চিন্তা করে দেখো, কারণ প্রভুই তোমাকে সব বিষয় বুঝবার ক্ষমতা দান করবেন।” (১তীমথিয় ২ : ১–৭), “যখন আমাদের কোন শক্তিই ছিল না তখন ঠিক সময়েই মসীহ্ আল্লাহর প্রতি ভয়হীন মানুষের জন্য, অর্থাৎ আমাদের জন্য প্রাণ দিলেন। কোন সৎ লোকের জন্য কেউ প্রাণ দেয় না বললেই চলে। যিনি অন্যের উপকার করেন সেই রকম লোকের জন্য হয়তো বা কেউ সাহস করে প্রাণ দিলেও দিতে পারে। কিন্তু আল্লাহ্ যে আমাদের মহব্বত করেন তার প্রমাণ এই যে, আমরা গুনাহ্গার থাকতেই মসীহ্ আমাদের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন” (রোমীয় ৫ : ৬–৮)। বাস্তব প্রেম তো এমনই হয়।