রাজশাহী সিটি করপোরেশনে (রাসিক) যারা ঠিকাদারি কাজ বাগাতেন, তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ নেতা। গেল ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব ঠিকাদারের অধিকাংশই পালিয়েছেন। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে নগরীর অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ। তবে ঠিকাদারি কাজ করতে গিয়ে ওই সব নেতা আগেভাগেই কোটি কোটি টাকার বিল পকেটে তুলে নেন।
রাসিক সূত্র জানায়, বর্তমানে সিটি করপোরেশনের ৪৬টি প্যাকেজের কাজ চলছে। এর মধ্যে মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌরিদ আল মাসুদ রনির রিথিন এন্টারপ্রাইজ এবং তাঁর মালিকানাধীন এআর কনস্ট্রাকশন সাতটি কাজ করছিল। এ ছাড়া ‘হুন্ডি ব্যবসায়ী’ মোখলেসুর রহমান মুকুলের প্রতিষ্ঠান মুন এন্টারপ্রাইজ করছিল ছয়টি প্যাকেজের কাজ। গত ৫ আগস্টও রনিকে দেখা গেছে ছাত্র–জনতার ওপর হামলায় নেতৃত্ব দিতে। সরকার পতনের পর থেকেই রনি নিরুদ্দেশ। ফলে তাঁর ঠিকাদারি কাজও বন্ধ। মোখলেসুর রহমানকে সবাই চেনে ‘হুন্ডি মুকুল’ নামে। গত সংসদ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান আসাদ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলে তাঁকে দেড় কোটি টাকার গাড়ি উপহার দিয়ে আলোচনায় আসেন ‘হুন্ডি মুকুল’। আসাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন রাসিকের সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। আসাদ–লিটনের রসায়নে তিনি সিটি করপোরেশনের অসংখ্য কাজ বাগিয়ে নেন। চলমান প্যাকেজ থেকে মুকুল একাই নিজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মুন এন্টারপ্রাইজের নামে ছয়টি কাজ করছিলেন। গত ৫ আগস্ট থেকে তিনি লাপাত্তা। তাঁর ঠিকাদারি কাজও এখন বন্ধ। দলীয় এমন আরও অনেক ঠিকাদার পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফলে তারা কাজ করতে পারছেন না।
রাজশাহী নগরীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পুকুরের সৌন্দর্যবর্ধন ও প্রতিরক্ষা প্রাচীর নির্মাণে ১৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকার কাজটি করছিল যুবলীগ নেতা রনির রিথিন এন্টারপ্রাইজ। ৭০ শতাংশ কাজের দাবি করে ইতোমধ্যে ৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকার বিলও তুলেছেন। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে আর কোনো কাজ হয়নি। নগরীর ধর্মসভা মন্দির ও ভবনের সৌন্দর্যবর্ধনের ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকার কাজটিও করছিল রনির মালিকানাধীন রিথিন এন্টারপ্রাইজ। ৮০ শতাংশ কাজ করার দাবি করে ইতোমধ্যে ৮৭ লাখ টাকার বিল তুলেছেন। ওই কাজও এখন বন্ধ।
নগরের রামচন্দ্রপুর বিহারি বাবুর পুকুর, টিকারপাড়া গোরস্তানের ভেতরে দুটি পুকুরের সৌন্দর্যবর্ধনে ৫ কোটি ৪২ লাখ টাকার কাজটিও করছিল রনির রিথিন এন্টারপ্রাইজ। ৮৩ শতাংশ কাজ করার দাবি করে তিনি ৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বিল তুলেছেন। এই কাজটিও বন্ধ। নগরীর ১৮, ১৯ ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে ৫ কোটি ৬ লাখ টাকার সিসি রাস্তা, কার্পেটিং ও ড্রেন নির্মাণ কাজটি ৫০ শতাংশ হয়েছে দাবি করে ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকার কাজ তুলেছে রিথিন এন্টারপ্রাইজ।
রনির মালিকানাধীন এআর কনস্ট্রাকশন ২৬ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে সিসি (ঢালাই) রাস্তা, কার্পেটিং, ড্রেন নির্মাণ কাজটি ২ কোটি ৯ লাখ টাকায় করছে। ৮৫ শতাংশ কাজ হয়েছে দাবি করে ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নগরীর ৬, ৭, ১০, ১৩, ১৭ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে সিসি, ড্রেন, ফুটপাত, প্রাচীর, কার্পেটিং রাস্তাসহ ১১ কোটি ৩৮ লাখ টাকার কাজটিও করছে এআর কনস্ট্রাকশন। ইতোমধ্যে ৪৫ শতাংশ কাজ করার ঘোষণা দিয়ে তিনি ৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বিল তুলেছেন। এসব কাজও এখন বন্ধ।
এআর কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড এমএস আলাউদ্দীন ট্রেডার্স নগরীর ছয়টি ঈদগাহ সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজটি করছে। ৪ কোটি ৮ লাখ টাকার এই কাজটি ৯৫ শতাংশ নির্মাণ হয়েছে উল্লেখ করে ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বিল তুলেছেন। এখানে রনির এআর কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে খোদ রাসিকের অপসারিত কাউন্সিলর ও মতিহার থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আলাদ্দীনের মালিকানাধীন এমএস আলাউদ্দীন নিজেই ঠিকাদারি করছিলেন। তবে তারা পলাতক থাকায় কাজটি আর এগোচ্ছে না। সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, সম্প্রতি মিলু নামে এক ব্যক্তি নিজেকে বিএনপি নেতা এবং রনির আত্মীয় পরিচয় দিয়ে নগর ভবনে যান। মিলু বলছেন, তাঁকে কাজগুলো করার দায়িত্ব দিয়েছেন রনি। তিনি শিগগিরই কাজগুলো শুরু করবেন।
হুন্ডি মুকুলের প্রতিষ্ঠান মুন এন্টারপ্রাইজ করছিল নগরীর মুন্নুজান স্কুলের সামনে পদ্মা নদীর বাঁধে ব্রিজ নির্মাণকাজ। ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকার কাজটি এখন বন্ধ। এই কাজের ৪২ শতাংশ হয়েছে দাবি করে তিনি ৫০ লাখ ১৫ হাজার টাকার বিল তুলেছেন। নগরীর সিঅ্যান্ডবি মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণের ৫ কোটি ২ লাখ টাকার কাজটিও করছিলেন হুন্ডি মুকুল। ৯০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বিল তুলেছেন ৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। তবে গত ৫ আগস্ট এই স্থাপনাটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ছাত্র–জনতা। রাজশাহী জজকোর্টের সীমানা প্রাচীর, ড্রেন, কার্পেটিং রাস্তা নির্মাণের ২ কোটি ৮৪ লাখ টাকার কাজটিও করছিলেন হুন্ডি মুকুল। ৬০ শতাংশ কাজ করার দাবি করে ১ কোটি ২১ লাখ টাকার বিল তুলে নিয়েছেন। তবে কাজটি এখন বন্ধ। নগরীর কেশবপুর দক্ষিণপাড়া, কোর্ট স্টেশন পূর্ব ও পশ্চিমের তিনটি জলাশয় সৌন্দর্যবর্ধনের ৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকার কাজ পেয়েছিলেন হুন্ডি মুকুল। তবে জটিলতা থাকায় কাজগুলো হয়নি। এর বদলে মাদ্রাসা, স্কুল ও বুলনপুরের পুকুরের কাজ করে ৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা বিল তুলেছেন তিনি। তিনি দাবি করেছেন, ৮২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তবে এখন কাজ বন্ধ।
নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে সিসি রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণে ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকার কাজটিও করছিলেন হুন্ডি মুকুল। ৫৫ শতাংশ কাজ করে বিল নিয়েছেন ৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েল সীমানা প্রাচীর নির্মাণের ১১ কোটি ১৮ লাখ টাকার কাজটিও করছিলেন তিনি। এই কাজের বিপরীতে ১ কোটি ২ লাখ টাকার বিল তুলে নিলেও এখন কাজই শুরু করতে পারেননি।
নগরীর ২ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আফসান চৌধুরীর ডন এন্টারপ্রাইজ কার্পেটিং ও নর্দমা নির্মাণকাজ করছিলেন। ৫০০ মিটারের মধ্যে সড়ক ২০০ মিটার ড্রেন ও নর্দমা নির্মাণ করে তিনিও পালিয়েছেন। ৫ কোটি ৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকার কাজটি থেকে তিনি ইতোমধ্যেই বিল তুলে নিয়েছেন ৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তবে এখন নির্মাণকাজ বন্ধ।
নগরীর ১৬, ১৭ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডের ড্রেন নির্মাণকাজ করছিলেন সাবিন এন্টারপ্রাইজের মালিক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ কবীর মুক্তা। ৫ দশমিক ৩ কিলোমিটারের মধ্যে তিনি শূন্য দশমিক ৭১ কিলোমিটার নির্মাণ করেছেন। ৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার কাজটির ২০ শতাংশ করে তিনি বিল তুলেছেন ৪৪ লাখ টাকা। ৫ আগস্টের পর তিনি পলাতক। তাঁর নির্মাণকাজও মুখ থুবড়ে পড়েছে।
এ ছাড়া রূপপুরের বালিশকাণ্ডের হোতা মজিদ সন্স সিটি করপোরেশনে করছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা কাজ। তাদের প্রতিটি কাজই চলছে ধীরগতিতে। নগরীর বিলসিমলা ফ্লাইওভার নির্মাণে ৮৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকার কাজটি করতে গিয়ে ইতোমধ্যেই ৮ কোটি ৩১ লাখ ৬৬ হাজার বিল তুলে নিয়েছে। নগরীর শালবাগান বাজার নির্মাণের ৪১ কোটি টাকার কাজটিও করছিল মজিদ সন্স। তবে জায়গা জটিলতায় কাজটির নির্মাণকাজ এগোয়নি। তবু ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা বিল তুলেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া ভদ্রা কাঁচাবাজার নির্মাণে ৩৮ কোটি টাকার কাজটিও পেয়েছে মজিদ সন্স। তবে এখনও কাজ শুরুই করতে পারেনি তারা। মজিদ সন্সের প্রকল্প ব্যবস্থাপক সারোয়ার জাহান বলেন, ‘ভদ্রা কাঁচাবাজার কাজ করার অনুমতি এখনও পাইনি। শালবাগান কাঁচাবাজারে অর্ধেক কাজ করেছি। ব্যবসায়ীদের আপত্তির কারণে কাজ বন্ধ আছে। কাজের চেয়ে অনেক কম বিল তুলেছি। আরও পাওনা আছে। এখন শুধু ফ্লাইওভারের কাজটি আমাদের চলমান আছে।’
এসব বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রকল্প পরিচালক মাহমুদুর রহমান ইমন বলেন, ঠিকাদার পলাতক থাকায় কিছু কাজ বন্ধ আছে। তবে তাদের পক্ষে এখন কেউ কেউ এসে কাজ শুরু করতে চাচ্ছেন। কাজ শুরু করলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। যারা বিল তুলেছেন, তারা যতটুকু কাজ করেছেন, ততটুকু বিল পেয়েছেন। এর পর যদি আর কাজ করতে না পারেন, তবে বাকি কাজ করার জন্য আলাদা ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে।