“আমি, আমিই আমার নিজের জন্য তোমার অন্যায় মুছে ফেলি; আমি তোমার গুনাহ আর মনে আনব না” (ইশাইয়া ৪৩ : ২৫)।
“পরে আমি বনিইসরাইলদের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করব তা হল, আমার শরীয়ত আমি তাদের মনের মধ্যে রাখব এবং তাদের দিলেও তা লিখে রাখব। আমি তাদের আল্লাহ হব আর তারা আমারই বান্দা হবে” (ইয়ারমিয়া ৩১ : ৩৩)।
উপরোক্ত আয়াত দু’টি প্রকাশ করে, মানুষের পাপ অপরাধ ধুয়ে মুছে তাকে স্নাতশুভ্র করার দায়িত্ব একমাত্র মাবুদের উপর বর্তায়। মানুষ সৃষ্টি করা হলো খোদার এক বিশেষ পরিকল্পনা, কেননা তিনি মানুষের সাথে মিলে মিশে থাকার জন্য অতবী আগ্রহ পোষণ করেন। “আর আল্লাহর থাকবার ঘরে প্রতিমার স্থান কোথায়? আমরা তো জীবন্ত আল্লাহর থাকবার ঘর। পাক–কিতাবে আল্লাহ বলেছেন, “আমি আমার লোকদের মধ্যে বাস করব, আর তাদেরই সংগে চলাফেরা করব। আমি তাদের আল্লাহ হব, আর তারা আমার নিজের বান্দা হবে।” আল্লাহ আরও বলেছেন, “এজন্য তোমরা অ–ঈমানদারদের মধ্য থেকে বের হয়ে এস ও আলাদা হও। কোন হারাম জিনিস ছুঁয়ো না, তাহলে আমি তোমাদের গ্রহণ করব।” এছাড়া “আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘আমি তোমাদের পিতা হব এবং তোমরা আমার ছেলেমেয়ে হবে” (২করিন্থীয় ৬ : ১৬–১৮)। যেমন দেহ ছাড়া আত্মা অকার্যকর একইভাবে আত্মা বা রূহ ছাড়া দেহ মৃত বা অকার্যকর। মাটির আদম ছিল দেহধারী অবয়ব মাত্র, যতক্ষণ পর্যন্ত তার মধ্যে রূহ অর্থাৎ খোদার জীবন বায়ু ফুঁকে দেয়া না হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত অকার্যকর প্রাণহীন একটি মূর্তী মাত্র। এ বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য অধিক যুক্তি জালের প্রয়োজন পড়ে না; কেননা আমাদের মধ্যে মৃত মানুষ আর জীবিত মানুষ অগণীত দেখার সুযোগ ঘটেছে। মূমুর্ষু ব্যক্তির ক্ষেত্রে সাধারণত প্রশ্ন করা হয়ে থাকে, শ^াস–প্রশ^াস চলছে কি চলছে না। অর্থাৎ ব্যক্তির মৃত্যুর ক্ষণ ঘনিয়ে আসছে তবে সময়ের অপেক্ষা মাত্র। খোদার পরিকল্পনা হলো মানুষ নিয়ে, কেননা এই মানুষই অদৃশ্য খোদার বহিপ্রকাশ ঘটানোর জন্য উপযুক্ত মাধ্যম। যদিও তিনি নিজেকে অর্থাৎ নিজের অভিপ্রায় নানাভাবে প্রকাশ করেছেন, যেমন প্রকৃতির মাধ্যমে, সৃষ্টির মাধ্যমে ইত্যাদি কিন্তু বাতেনী খোদার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে মানুষের মাধ্যমে। আদম হলেন প্রথম মানুষ যাকে খোদার সুরত দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন; কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তিনি চরমভাবে ধোকা খেল খোদার দুষমন অভিশপ্ত ইবলিসের দ্বারা, যার কুফল দেখা গেল, আদম চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলো খোদার হুবহু বহিপ্রকাশ ধরে রাখতে। কাঁচের পাত্র পাষানের আঘাতে খানখান টুকরো টুকরো হয়ে গেলে হারিয়ে ফেলে কার্যকারীতা। আদমের ক্ষেত্রটিও একইরূপ।
মানুষকে সুরক্ষা করার জন্য মাবুদ দ্বিতীয় আর একটি পারফেক্ট নিপুণ ব্যবস্থা হাতে নিলেন, যা হলো স্বীয় কালাম ও পাকরূহ মানবরূপে জগতে প্রেরণের মাধ্যমে। তিনি হলেন খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসীহ, যিনি সম্পূর্ণ বেগুনাহ ব্যক্তি মানুষের মধ্যে মানুষরূপে আগত। তিনি অপঘাতে বিদ্ধ মানুষকে দোষারোপ করার জন্য আগত নন, বরং আর্তপীড়িত দুঃস্থদের সেবা দান করে সুস্থ করে তোলার জন্য মুল্য দিয়েছেন।
হাসপাতালে সর্বপ্রকার রোগীর চিকিৎসা হয়ে থাকে। যথাযথ চিকিৎসার শেষে ব্যক্তি সুস্থ হয়ে নিজের ঘরে ফিরে যায় এবং পেশাগত কাজে পুনরায় যোগদান করে, যা হলো স্বাভাবিক নিয়ম। খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসীহ যাদের গুনাহমুক্ত করেছেন তাদের পুনরায় সমাজে ফেরত পাঠিয়েছেন যেন তারা গিয়ে প্রমান বহন করতে পারেন মসীহের দয়ায় সুস্থতা আসে, বখে যাওয়া মানুষ পুনরায় সাধুসন্তে ফিরে আসার সুযোগ লাভ করে। মানুষকে ধ্বংস করার জন্য তিনি মানুষ সৃষ্টি করেন নি; মানুষের ক্ষতি সাধন করা হলো অভিশপ্ত ইবলিসের একক ব্রত। খোদা আগে–ভাগেই সে বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছেন, মানুষ যেন লানতী ইবলিকে ঘৃণা করে এবং তাড়িয়ে ফেরে। শয়তানকে সুযোগ দিলে নগর জনপদ লন্ডভন্ড করে ছাড়ে, যার যথার্থ প্রমাণ ইতোপূর্বে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, বিশে^র ঘটে যাওয়া নরঘাতী যুদ্ধ সমূহের মাধ্যমে। যুদ্ধ কখনো বিবাদের সমাধান বয়ে আনতে পারে না, খুনের বদলা খুন কেবল খুনের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলে।
মানুষের মধ্যে বাধবিভেদ যতটা সৃষ্টি হয়েছে তা পার্থীব কোনো কারণে যে ঘটেছে তা বলা যাবে না, কেননা তারা সকলেই খোদার হাতে সৃষ্ট মানুষ, সকলেই হলো খোদার প্রতিনিধি। প্রতিনিধি সদাসর্বদা একদিকে মালিকের সাথে সংলগ্ন থাকে আর একদিকে প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে রাখে সুসম্পর্ক; কেউ কারো বিরুদ্ধে দুর্ণাম বদনাম করে না বা তেমন সুযোগও তাদের থাকে না, কেননা তারা সকলে একই সংগঠনের প্রতিনিধি, নিজেদের পণ্য জনসাধারণের কাছে তুলে ধরে ও পরিচয় করিয়ে দেয়। যতদিন প্রতিনিধিরা একই মালিকের অধীনে কাজ করে ততদিন তারা কেউ কারো বিরুদ্ধে যায় না, তবে কেউ যদি মালিকানা বদলে ভিন্ন মালিকের অধীনস্থ হয়ে পড়ে তখন তাদের অবশ্যই প্রথম মালিকের বিরুদ্ধে ত্রæটি–বিচ্যুতি গোমর ফাঁস করতে থাকে। সকল মানুষ খোদার প্রতিনিধি। খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসীহ তাদের তুলনা করেছেন জগতের নূরের সাথে। এক্ষেত্রে একটি মোম দন্ডের কথাই বলা যাক। মোম দন্ড তৈরী হয়ে থাকে নানান আকৃতিতে, বড়, ছোট, জন্মদিনের মোম, আবার বিশাল আকরের ক্যাথেড্রালে মঞ্চের পাশে দাড় করিয়ে রাখা হয়। এর সবগুলোই মোমদন্ড, তবে ভিন্ন ভিন্ন আকারে গড়া। কিন্তু ওগুলো যখন জ¦ালানো হয় তখন আলোর মধ্যে কোনো ভিন্নতা থাকে না। সত্যিকারের খোদার নোমায়েন্দা যখন কথা বলেন তখনও একই খোদার বিপরীতধর্মী বয়ান দেবার অধিকার, ক্ষমতা বা যুক্তি রাখে না। তবে কেউ যখন সত্যিকারের খোদার কাছ থেকে সরে গেল, খোদার উপ নিখুঁত নির্জলা বিশ^াস হারিয়ে ফেলল, আর অভিশপ্ত ইবলিসের তাবেদারী করতে শুরু করলো, তখন ব্যীক্ত নিজে যেমন লানতী হয়ে পড়লো, অন্যকেও লানতের পথে পরিচালনা করার জন্য তালগোল পাকানো উল্টাপাল্টা ফতোয়া দিতে থাকে; যার ফলে প্রতিনিধিদের মধ্যে লেগে যায় বিবাদ, কলহ লঙ্কাকান্ড। খোদার নোমায়েন্দা কিভাবে মালিক বদল করে? ভিন্ন কি কোনো খোদা রয়েছে জগতে? মূসা নবীর মাধ্যমে ঘোষীত খোদার পরিচয় জানতে পাই, “বনি–ইসরাইলরা, শোন, আমাদের মাবুদ আল্লাহ এক। তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের সমস্ত দিল, সমস্ত প্রাণ ও সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহকে মহব্বত করিবে” (দ্বিতীয় বিরণ ৬ : ৪–৫)। একই বাণী আমরা খোবন্দ হযরত ঈসা মসীহের জবানীতে শুনতে পাই। “ঈসা সদ্দূকীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন শুনে ফরীশীরা একত্র হলেন। তাঁদের মধ্যে একজন আলেম ঈসাকে পরীক্ষা করবার জন্য জিজ্ঞাসা করলেন, “হুজুর, তৌরাত শরীফের মধ্যে সবচেয়ে বড় হুকুম কোনটা?” ঈসা তাঁকে বললেন, “সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে দরকারী হুকুম হল, ‘তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের সমস্ত দিল, সমস্ত প্রাণ ও সমস্ত মন দিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহকে মহব্বত করবে।’ তার পরের দরকারী হুকুমটা প্রথমটারই মতÑ ‘তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত মহব্বত করবে।’ সম্পূর্ণ তৌরাত শরীফ এবং নবীদের সমস্ত কিতাব এই দু’টি হুকুমের উপরেই ভরসা করে আছে” (মথি ২২ : ৩৪–৪০)। “যিনি মহান ও গৌরবে পূর্ণ, যিনি চিরকাল জীবিত, যাঁর নাম পবিত্র, তিনি বলছেন, “আমি উঁচু ও পবিত্র জায়গায় বাস করি, কিন্তু যার মন ন¤্র, যার মন ভেংগে চুরমার হয়েছে আমি তার সংগেও বাস করি যাতে ন¤্রদের ও মন ভেংগে চুরমার হওয়া লোকদের দিলকে আমি নতুন করে তুলতে পারি” (ইশাইয়া ৫৭ : ১৫)। “একদিন মূসা তাঁর শ^শুর শোয়াইব, অর্থাৎ রূয়েলের ছাগল–ভেড়ার পাল চরাচ্ছিলেন। শোয়াইব ছিলেন মাদিয়ানীয়দের একজন ইমাম। ছাগল–ভেড়ার পাল চরাতে চরাতে মূসা মরুভূমির অন্য ধারে আল্লাহর পাহাড়, তুর পাহাড়ের কাছে গিয়ে পৌঁছালেন। সেখানে একটা ঝোপের মাঝখানে জ¦লন্ত আগুনের মধ্য থেকে মাবুদের ফেরেশতা তাঁকে দেখা দিলেন। মূসা দেখলেন যে, ঝোপটিতে আগুন জ¦ললেও সেটা পুড়ে যাচ্ছে না। এই ব্যাপার দেখে তিনি মনে মনে বললেন, “আমি এক পাশে গিয়ে এই আশ্চর্য ব্যাপারটা দেখব, দেখব ঝোপটা পুড়ে যাচ্ছে না কেন।” ঝোপটা দেখবার জন্য মূসা একপাশে যাচ্ছেন দেখে মাবুদ আল্লাহ ঝোপের মধ্য থেকে ডাকলেন, “মূসা, মূসা।” মূসা বললেন, “এই যে আমি।” মাবুদ বললেন, “আর কাছে এসো না। তুমি পবিত্র জায়গায় দাঁড়িয়ে আছ। তোমার পায়ের জুতা খুলে ফেল। আমি তোমার পিতার আল্লাহ; আমি ইব্রাহিম, ইসহাক ও ইয়াকুবের আল্লাহ।” তখন মূসা তাঁর মুখ ঢেকে ফেললেন, কারণ আল্লাহর দিকে তাকাতে তাঁর ভয় হল” (হিজরত ৩ : ১–৬)। “আমি আল্লাহ তোমাদের মাবুদ। সেজন্য তোমরা আমার উদ্দেশ্য নিজেদের আলাদা করে রাখবে এবং পবিত্র হবে, কারণ আমি পবিত্র। মাটির উপরে ঘুরে বেড়ানো ছোটখাট কোন প্রাণী দিয়ে তোমরা নিজেদের নাপাক করবে না, কারণ আমি মাবুদ; তোমাদের আল্লাহ হওয়ার জন্য মিসর দেশ থেকে তোমাদের বের করে এনেছি। আমি পবিত্র বলে তোমাদেরও পবিত্র হতে হবে” (লেবীয় ১১ : ৪৪–৪৫)। “কিন্তু আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ন্যায়বিচার করে মহান থাকবেন; আল্লাহ্ পাক তাঁর সততার জন্য পবিত্র বলে প্রকাশিত হবেন ” (ইশাইয়া ৫ : ১৬)।
আমাদের সাধবান থাকতে হবে অভিশপ্ত ইবলিসের ভ্রান্তি থেকে। শয়তানের কুটচালে বিবি হাওয়া নিষিদ্ধ ফল নিজে খেল এবং তার স্বামী আদমকেও খাওয়ালো, যার পরিণতি গোটা বিশ^ ভুগে চলছে। “নিজেদের দমনে রাখ ও সতর্ক থাক, কারণ তোমাদের শত্রæ ইবলিস গর্জনকারী সিংহের মত করে কাকে খেয়ে ফেলবে তার খোঁজ করে বেড়াচ্ছে। ৯ঈমানে স্থির থেকে ইবলিসকে রুখে দাঁড়াও, কারণ তোমরা তো জান যে, সারা দুনিয়ার মধ্যে তোমাদের ঈমানদার ভাইয়েরা একই রকম দুঃখ–কষ্ট ভোগ করছে” (১ম পিতর ৫ : ৮–৯)। “যে গুনাহ করতেই থাকে সে ইবলিসের, কারণ ইবলিস প্রথম থেকেই গুনাহ করে চলেছে। ইবলিসের কাজকে ধ্বংস করবার জন্যই ইবনুল্লাহ প্রকাশিত হয়েছিলেন ” (১ইউহোন্না ৩ : ৮)।