গ্রামের হাট–বাজারে দেখেছি বেল বা শ্রীফল বিক্রেতাদের কর্মকান্ড, শ্রীফলগুলো পাঁকা বা কাঁচা প্রমাণ করার জন্য ক্রেতাদের দেখাতে, একটি কাঁচা বেল দিয়ে আর একটি বেল ভাঙ্গা হয়। কথায় বলে বেল দিয়ে বেল ভাঙ্গা।
বিবেচনা করে দেখুন, গোটা বিশ্বে তেমন প্রক্রিয়ায় আজ কি চলছে না? মানুষ দিয়ে মানুষ খতম। দৈত যুদ্ধ বলুন আর বিশ্বযুদ্ধ বলুন, যুদ্ধতো পরিষ্কার এক পক্ষ আর এক পক্ষকে বিনাশ করে ছাড়ে। তা উভয় পক্ষইতো মানুষ; গোলাবারুদ মারণাস্র যারা পরিচালনা করে তারাও মানুষ বৈ ভিন্ন কিছু নয়। প্রতিরক্ষা বাহিনী কেবল মানুষ। দুই বিবদমান দেশে যুদ্ধ বাধার অর্থ হলো উভয় পক্ষের সৈন্যসামন্ত ক্ষয় হওয়া, তাহলে যুদ্ধের ফল কি দাড়ালো? মানব নিধন! নৃপতির আদেশে নরপুরী বিনাশপ্রাপ্ত হওয়া। বলতে কি পারেন কে শুরু করেছিল নরঘাতি যুদ্ধকৌশল? আদমের পুত্র কাবিল স্বীয় ভ্রাতা হাবিলকে হত্যা করার মাধ্যমে মানব সমাজে সর্বপ্রথম নরবিনাশী সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। বর্তমানে সশস্র লড়াই চলে আসছে দেশে দেশে। খোদার পরিকল্পনা হলো একই পরিবারের মাধ্যমে জাত সকল মানবজাতি বসবাস করবে ভ্রাতৃত্ত¡ সহমর্মীতার আবহ সৃষ্টি করে। মানুষের সাথে মানুষের মিলন সহভাগিতা বজায় থাকাই হলো খোদার নির্দেশনার বাস্তবায়ন। তিনি প্রথম মানুষ আদমকে মাত্র একটি হুকুম দিলেন, যা হলো, প্রজাবন্ত হওয়া এবং গোটা বিশ্ব আবাদ করে মানব সৃষ্টির স্বার্থকতা প্রতিষ্ঠা করা। দুঃখের বিষয় হলো, মানুষ প্রথমেই কুটকৌশলী ইবলিসের চালে ধরা খেয়ে অস্বীকার করে বসলো খোদার মহিমা। তারা ভেবে নিল, ইবলিস তাদের কল্যাণজনক কাজে সহায়ক, যতটা খোদার পক্ষ থেকে তারা উপকৃত না হয়েছে। এক্ষেত্রে দেহের কামনা, চোখের লোভ আর সাংসারিক বিষয়ের অহংকার করার মত অধিকার রয়েছে ইবলিসের মন্ত্রে। তারাও ছিলেন মাটির দেহধারী ক্ষুত পিপাসাকাতর মানুষ। মানুষ যে কেবল রুটিতে বাঁচে না, খোদার মুখের কথাতেই মানুষের জন্ম হয়েছে এবং দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বিশ্বচরাচর যে খোদার মুখের বাণীতে সম্পন্ন হয়েছে তা আদম হাওয়া সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন। যেমন বর্তমানকার মানব সমাজ আমরা, আমাদের কাছে খোদার গুরুত্ব কতটা রয়েছে?
খোদার পথ থেকে আমরা ইতোমধ্যে বহুদুরে সরে গেছি, যা হলফ করে বলতে পারি। বর্তমানে আমরা দেহসর্বস্ব হয়ে পড়েছি, আমরা একান্ত স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রীক, পান থেকে চুনটুকু খসে পড়লে আমরা আঘাত করে বসি। অপরের ত্রুটিবিচ্যুতি ফলাও করে প্রচার প্রকাশ করতে আমরা তুখোর, কিন্তু নিজেদের জীবনে ঘটে চলা অন্যায় অসামাজিক কর্মকান্ড প্রবণতা ঢেকে রাখার জন্য কতকিনা অজুহাত দাগ করায়। নিজেদের উলঙ্গতা ঢেকে রাখার জন্য ডুমুর পাতা দিয়ে নিমা তৈরী করেছিল আদম হাওয়া, আসলে তা ছিল তাদের ব্যার্থ প্রয়াস মাত্র। কালামপাকে তো পরিষ্কারভাবে বর্ণীত রয়েছে, আমরা সকলে পাইকারীহারে গুনাহগার, জন্মলগ্নে প্রত্যেকটি সন্তান ইবলিস স্পর্শ করে ছাড়ে। আদম অবাধ্য হওয়াতে তার ঔরষজাত সন্তান গোটা বিশ^ উত্তরাধীকার সূত্রে গুনাহগার। শুধু কি তাই, প্রত্যেকে অপরাধ কর্মে সিদ্ধহস্ত। আদম বংশে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কি সম্ভব যে কিনা গোটা জীবন নিষ্পাপ থাকতে পেরেছেন? তারপর যারা সশস্র যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত ছিল, যারা নিজেদের হাতে মানুষ কতল করেছে তাদের বিষয়ে আজ আমরা কি বলব? আমরা কি বাস্তব ইতিহাস পুড়ে ফেলব, যাতে ওগুলো আর পড়তে না হয়, কেউ যেন জানতে না পারে তথাকথিত পূজনীয় ব্যক্তিদের জীবনালেখ্য। কেবল মূর্খ আনপড় অন্ধ সমাজের পক্ষে তা মানানসই হলে হতে পারে, তাই বলে সুশিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ নরঘাতিদের পূজা দিবে কেমন করে? ভ্রান্তি আর ভ্রান্তি!
যদিও মানবজাতি মাত্র একই পরিবার থেকে হয়েছে জাত, তবুও আজ তারা হয়ে পড়েছে শতকোটি বৈরী ভাগে বিভক্ত। কেউ কাওকে আর আপন ভাবতে পারছেনা। খোদার হুকুমে ঐক্যে বাস করা, তথাপি কে শোনে কার কথা। খোদার হুকুমের সাথে নিজেদের সুবিধাবাদী মন্ত্র জুড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে ধোকা দিয়ে ফিরছে। মানুষ নিরক্ষর হতে পারে, তাই বলে একজন আর একজনকে মানুষ হিসেবে বুঝতে কোনো বেগ পাবার কথা নয়। ব্যক্তিগত পরিচয় জানার জন্য একটু সময় লাগে, মানুষের স্বভাব আচরণ, বিদ্যাবুদ্ধি মেধা ইত্যাদি জানার জন্য অবশ্যই সময় দিতে হবে বৈ কি।
বিবদমান বিশ্বে ভ্রাতৃত্ত¡, মৈত্রী, সহমর্মীতা, আন্তরিকতা ঐকমত্য পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাদের সকলকে পারষ্পরিক আন্তরিক মর্যাদা ও ভালবাসা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের অবশ্যই বৈরিতার মনোভাব দূর করে হৃষ্ট চিত্তে “মানুষ মানুষের জন্য” ধারণাটি মনে প্রাণে মেনে নিতে হবে। সকল মানুষ প্রেমময় খোদার প্রতিনিধি, বুঝতে হবে তিনি বৈষম্যহীনভাবে সকল মানুষের কল্যাণের চিন্তা করেন। কেউ কাওকে ঘৃণা করার অধিকার আমাদের দেয়া হয় নি, বরং পরষ্পর প্রেম অনুগ্রহে একজন অন্যজনকে গেঁথে তোলার জন্য আগ্রহী থাকতে হবে। আল্লাহপাক মানুষকে যে হুকুম দিয়েছেন তার মাধ্যমে প্রতিবেশিকে আত্মবৎ প্রেম করার তাগিদ অন্যতম। যেমন লেখা আছে, “ঈসা তাঁকে বললেন, “সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে দরকারী হুকুম হল, ‘তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের সমস্ত দিল, সমস্ত প্রাণ ও সমস্ত মন দিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহকে মহব্বত করবে।’ তার পরের দরকারী হুকুমটা প্রথমটারই মতÑ ‘তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত মহব্বত করবে।’ সম্পূর্ণ তৌরাত শরীফ এবং নবীদের সমস্ত কিতাব এই দু’টি হুকুমের উপরেই ভরসা করে আছে।” (মথি ২২ : ৩৭–৪০)।
কেউ যদি আন্তরিকভাবে খোদার ইজ্জত করে তবে অবশ্যই তার প্রতিবেশিকে ইজ্জত করতে হবে। কথায় আছে, যে লোক দেখা ভাইকে মহব্বত করতে ব্যর্থ সে যে অদেখা খোদার সম্মান করে তা মেনে নেয়া কি কঠিন নয়? আর খোদা হলেন এক রূহানী সত্ত্বা, যার সেবা বা পূজা আরাধনা হবে রূহে ও সত্যে। দৈহিক অঙ্গভঙ্গি বা পার্থীব বস্তুর সমাহারের কোনো প্রয়োজন পড়ে না খোদার প্রতি বন্দনা প্রকাশ করার জন্য। তাছাড়া খোদা হলেন অন্তর্যামী, যিনি মানুষের হৃদয়ের গভীরে যা কিছু আছে তাও দেখতে পান। আপনি হৃদয় দিয়ে যখন খোদার শরণ নিবেন অমনি তিনি তা বুঝতে পারেন। লেখা আছে, ডাকিবার পূর্বেই তিনি জবাব দিয়ে থাকেন (ইশাইয়া ৬৫ : ২৪)। এর অর্থ হলো কোনো কিছু মুখে প্রকাশ করার পূর্বে মানুষ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকে, তারপর তা বাক্যে রূপ দেয় এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করে। মানুষ তখন জানতে পারে ব্যক্তির মনের গোপন কথা। কিন্তু খোদা যেহেতু অন্তর্যামী তাই তিনি মানুষের মনের ভাবটুকুও বুঝতে পারেন। গোটা বিশ্ব আজ অশান্তির দাবদাহে জ¦লে পুড়ে ভষ্মাচ্ছাদিত। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে সর্বত্র চলছে প্রলয়ংকরী প্রাণঘাতি যুদ্ধের দামামা। আর জানেন তো যুদ্ধ কেবল মানুষ খতম করে ফিরছে মানুষকে। স্থান–কাল–পাত্র ভাষা মতবাদ ইত্যাদি যেগুলো কেবল বাহ্যিক ক্ষণভঙ্গুর, তার জন্য খোদার প্রতিনিধিদের করছে কচুকাটা। খোদার প্রাণপ্রতীম মানুষের রক্তে যখন আপনার হাত হলো রঞ্জিত, তারপরেও দাবি তুলছেন, আপনি একজন খোদাভক্ত, খোদার প্রেমে পাগলপারা, ভাবখানা কেবল প্রহসন! খোদা তাঁর স্রেষ্ঠ সৃষ্টির হৃদয়ে থাকেন সদা সমাসীন। যদিও তিনি আসমান জমিনের মালিক, তা সত্তে¡ও তিনি স্বীয় হাতে গড়া গৃহে বসবাস করার জন্য থাকেন সর্বদা ব্যাকুল। তবে একটা বিষয় হলো, সবকটা গৃহ যে সমভাবে পরিষ্কার ও বসবাসের উপযোগী রয়েছে তা কিন্তু নয়, তাই তিনি আজ্ঞা করেছেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তাঁর জন্য প্রস্তুত রাখতে।
মানুষ খোদার আবাসগৃহ। আপনি আমি আমরা সকলেই। যদিও আমরা জাগতিক আকর্ষণে হয়ে আছি আকৃষ্ট, কখনো কখনো ভুলেই যাই প্রেমের পারাবার মাবুদকে, যিনি নিয়ত নির্ঘুম নিষ্পলক নেত্রে আমাদের প্রতি তাকিয়ে আছেন, আমরাও যেন তার চোখে চোখ রেখে প্রত্যয়োক্তি করতে পারি “আমি তোমায় ভালবাসি” প্রভু তুমি ছাড়া আমার খাঁটি বান্ধব আর কেউ নেই।
মারাত্মক ব্যাধি থেকে সারিয়ে তোলার হাত তো কেবল তোমারই আছে। মৃতকে জীবন দান করে প্রমাণ দিয়েছো তুমি আমাদের অনন্ত জীবন দান করেছো, যদিও মাটির দেহে রয়েছে মোদের ক্ষণকালের বসতী, যে রূহ আমাদের মধ্যে ফুঁকে দিয়েছো তিনি তো তোমার সাথে যুক্ত আছেন অনন্তকালের জন্য। কালামপাকে বিষয়টি এভাবে বর্ণীত রয়েছ, “অশেষ মহব্বত দিয়ে আমি তোমাদের মহব্বত করেছি; অটল মহব্বত দিয়ে আমি তোমাদের কাছে টেনেছি” (ইয়ারমিয়া ৩১ : ৩) “আমাদের হযরত ঈসা মসিহের পিতা ও আল্লাহর প্রশংসা হোক। আমরা মসিহের সংগে যুক্ত হয়েছি বলে বেহেশতের প্রত্যেকটি রূহানী দোয়া আল্লাহ আমাদের দান করেছেন। আমরা যাতে আল্লাহর চোখে পবিত্র ও নিখুঁত হতে পারি সেজন্য আল্লাহ দুনিয়া সৃষ্টি করবার আগেই মসীহের মধ্য দিয়ে আমাদের বেছে নিয়েছেন। তাঁর মহব্বতের দরুন তিনি খুশী হয়ে নিজের ইচ্ছায় আগেই ঠিক করেছিলেন যে, ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে তাঁর সন্তান হিসাবে তিনি আমাদের গ্রহণ করবেন” (ইফিষীয় ১ : ৩–৫) “আর তিনি যাদেরকে আগে নির্ধারণ করলেন, তাদেরকে আহ্বানও করলেন, আর যাদেরকে আহ্বান করলেন, তাদেরকে ধার্মিক প্রতিপন্ন করলেন; আর যাদেরকে ধার্মিক প্রতিপন্ন করলেন, তাদেরকে মহিমান্বিতও করলেন” (রোমীয় ৮ : ৩০)।