দেশে সর্বশেষ এক দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের নিয়ে চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১৯ জনের মৃত্যু হলো। এ ছাড়া এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে ৫৩৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কীটতত্ত্ববিদদের মতে, এডিস এজিপটির তুলনায় এডিস অ্যালবোপিকটাস নিয়ন্ত্রণ করা অনেক বেশি জটিল। এই জটিলতার কারণে গ্রামীণ এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। এডিস অ্যালবোপিকটাস সাধারণত প্রাকৃতিক জলাধারে বেড়ে ওঠে। তাদের মতে, এডিস মশা মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থাগুলোর মধ্যে পরিকল্পনা, সমন্বয় ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চলতি মাস থেকে ডেঙ্গুর জন্য আরও ভয়ঙ্কর। তাই দ্রুততার সাথে মশা নিধন করতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের হাসপাতালে। অপরদিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং খুলনা বিভাগের হাসপাতালে একজন করে মোট তিনজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে সর্বোচ্চ ১২১ জন ভর্তি হয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১৩ জন ভর্তি হয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে (সিটি করপোরেশনের বাইরে)। এ ছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৯০ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলোয় ৭৮ জন, খুলনা বিভাগের হাসপাতালগুলোয় ৫৯, বরিশাল বিভাগের হাসপাতালগুলোয় ৩৭, রাজশাহী বিভাগের হাসপাতালগুলোয় ১৮, ময়মনসিংহ বিভাগের হাসপাতালগুলোয় ১৭ ও রংপুর বিভাগের হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ১ জন ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬ হাজার ৮১৯ জন। এ সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে ৫২ শতাংশ নারী ও পুরুষ ৪৮ শতাংশ। জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষ ও নারী ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ। এ সময় হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৫ হাজার ৫৩ জন। আর গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৫০৭ জন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয় গত বছর। এ সময় ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। আর মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের।
রাজধানী ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ ব্যাপক আকারে বেড়েছে। বিছানা, মেঝে, বারান্দা কোথাও জায়গা মিলছে না। রোগী বাড়ায় হাসপাতালগুলোতে সেবা প্রদান করতে গিয়ে চিকিৎসক–নার্সরা যেমন হিমশিম খাচ্ছেন তেমনি রোগীরাও পড়ছেন নানান ভোগান্তি আর বিড়ম্বনায়। একই সঙ্গে রোগী বাড়ায় ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জামের সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় হাসপাতালে হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর চাপ। বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে খেই হারাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। এদিকে গত সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত শেষ ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে এ বছরের রেকর্ড ৬১৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে শুধু ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৪৬ জন। এ সময়ে মারা গেছেন একজন। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়েছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, আগস্টে দৈনিক চার থেকে পাঁচজন ডেঙ্গু রোগী এ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এখন রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু ওয়ার্ডে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন না থাকায় জটিল রোগীকে অন্য ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মানিকনগরের বাসিন্দা আলম জানান, গত ২ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। অবস্থা জটিল হওয়ায় সরকারি হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন চিকিৎসক। কয়েক হাসপাতাল ঘুরে শয্যা না পেয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হন তিনি। পরীক্ষা–নিরীক্ষা, ওষুধ, স্যালাইন বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতাল থেকে মশারি দেওয়া হলেও গরমের কারণে ব্যবহার করছেন না রোগীরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে–নজীর আহমেদ বলেন, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তাই এখনই এডিস মশা নিধন কর্মসূচি বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদারকি বাড়াতে হবে। ঢাকার প্রতিটি হাসপাতালে পর্যাপ্ত শনাক্তকরণ কিট ও আইভি ফ্লুয়েড সরবরাহ করতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবেও মজুত বাড়াতে হবে, যাতে কোথাও প্রয়োজন হলে দ্রুত সরবরাহ করা যায়।