মেট্রোরেল চালুর মাধ্যমে দীর্ঘ এক মাস ছয়দিন পর কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে রাজধানীবাসীর মধ্যে। প্রতিদিনের যানজটের ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেয়েছেন অনেক যাত্রী। বিশেষ করে মিরপুর ও উত্তরাগামী যাত্রীদের অফিস শেষে প্রতিদিন এক থেকে দেড় ঘণ্টা সড়কে আটকে থাকতে হতো। অথচ মেট্রোরেল চালুর ফলে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছানো যাচ্ছে বলে যাত্রীরা জানান। এতে অনেকটাই স্বস্তিতে যাতায়াত করা যাচ্ছে বলে জানান তারা।
এদিকে মেট্রোরেল চালুর প্রথমদিন রবিবার রাজধানীর আগারগাঁও থেকে সচিবালয় স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনে ভ্রমণ করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ সময় তিনি জানান, ভাঙচুর ঠেকাতে আধুনিক নগর গণপরিবহন মেট্রোরেলকে জরুরি সেবা (কেপিআই) হিসেবে ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সরেজমিনে মেট্রোরেলের বিভিন্ন স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, রবিবার সকাল ১০টার পর থেকে প্রতিটি মেট্রোস্টেশনে যাত্রীদের চাপ বাড়তে থাকে। রাজধানীর উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে সকাল ৭টা ১০ মিনিটে ছেড়ে আসে প্রথম মেট্রোরেল। এটি মতিঝিল স্টেশনে পৌঁছায় সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে। ওই ট্রেনটি মতিঝিল স্টেশন থেকে সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে আবার উত্তরার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। তবে সকালের দিকে মেট্রোরেলে যাত্রীদের চাপ কিছুটা কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অফিসগামী যাত্রীদের চাপ বাড়তে থাকে। তাই দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর মেট্রোরেল চালু হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেন যাত্রীরা।
রাজধানীর মতিঝিল স্টেশনে আনিস নামের এক যাত্রী বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর আবার মেট্রোরেলে অফিসে আসলাম। প্রায় এক মাসের বেশি সময় বন্ধ ছিল মেট্রোরেল। এ সময় অনেকটা কষ্ট করে মতিঝিলের অফিসে যাতায়াত করতে হতো। মিরপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাসে আসতে প্রতিদিন এক ঘণ্টা সময় লাগত।
অফিস শেষে ফেরার সময় আরও বাজে অবস্থা তৈরি হতো। বিভিন্ন সড়কে আন্দোলনের কারণে প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হতো। আজকে মাত্র ৩০ মিনিটে মতিঝিল চলে এলাম।’ এতে অনেকটা স্বস্তি প্রকাশ করেন তিনি।
আমিনুল নামের অপর এক যাত্রী বলেন, ‘গত বছর মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর এই গণপরিবহনে যাতায়াতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মাঝে ৩৭ দিন মেট্রোরেল বন্ধ থাকায় যানজটে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। ২৫ মিনিটের রাস্তা যাতায়াতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লেগেছে। মেট্রোরেল চালু হওয়ায় যাত্রীদের মধ্যে খুবই আনন্দ কাজ করছে। সবার একটাই চাওয়া, মেট্রো চলাচল যাতে আর বন্ধ না হয়।’
মিরপুর থেকে মেট্রোরেলে করে সচিবালয় স্টেশনে নামেন চাকরিজীবী সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আগে বাসার সামনে কাজীপাড়া থেকেই মেট্রোতে উঠতে পারতাম। কিন্তু এখন ওই স্টেশন বন্ধ থাকায় শেওড়াপাড়ায় এসে উঠতে হচ্ছে। তারপরও মেট্রো চালু হওয়ায় খুশি। দ্রুত মিরপুর–১০ ও কাজীপাড়া স্টেশন ঠিক করে চালু করা প্রয়োজন।’
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানায়, গত জুলাই মাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ডাকা আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। গত ১৯ জুলাই হামলা করা হয় মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর–১০ স্টেশনে। এর আগে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে গত ১৭ জুলাই বিকেল থেকে বন্ধ রাখা হয় মেট্রোরেল চলাচল।
পরে গত ২০ জুলাই সকালে জরুরি মেরামতের প্রয়োজনে এবং জনগণের জানমালের নিরপত্তার স্বার্থে পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে গত ১৭ আগস্ট থেকে মেট্রোরেল চালু ঘোষণা দেওয়া হলেও ডিএমটিসিএল’র কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্মবিরতির কারণে তা সম্ভব্য হয়নি। তাই দীর্ঘ এক মাস ছয়দিন বন্ধ থাকার পর রবিবার থেকে পুরোদমে চালু হলো মেট্রোরেল সার্ভিস।
তবে অনিবার্য কারণবশত মিরপুর–১০ ও কাজীপাড়া মেট্রোস্টেশনে যাত্রী ওঠা–নামা বন্ধ থাকবে। প্রতিদিন ১০টি ট্রেন দিয়ে মেট্রোরেল সার্ভিস পরিচালিত হচ্ছে বলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল)’র কর্মকর্তারা জানান। এ বিষয়ে ডিএমটিসিএল’র ম্যানেজার মাহফুজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘রবিবার থেকে ১০টি ট্রেন দিয়ে পুরোদমে যাত্রী সার্ভিস শুরু হয়েছে। প্রতিদিন তুলনামূলক যাত্রীদের চাপ কিছুটা কমছিল।
অনেকে হয়তো এখনো জানে না মেট্রোরেল সার্ভিস চালু হয়েছে। তবে অফিস সময় যাত্রীদের চাপ কিছুটা থাকে তবে অন্য সময় থেকে কিছুটা কম।’ আশা করছি দুই–একদিন পর যাত্রীদের চাপ আরও বাড়বে বলে জানান তিনি।
ভাঙচুর ঠেকাতে আধুনিক নগর গণপরিবহন মেট্রোরেলকে জরুরি সেবা (কেপিআই) হিসেবে ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
রবিবার মেট্রোরেলের সচিবালয় স্টেশনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। সাম্প্রতিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার জেরে দীর্ঘ ৩৭ দিন বন্ধ ছিল মেট্রোরেল। রবিবার সকালে চালু হলে মেট্রোরেলে আগারগাঁও থেকে সচিবালয় স্টেশন পর্যন্ত ভ্রমণ করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
পরে সচিবালয় মেট্রোস্টেশনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, মেট্রোরেলে যেন আর ভাঙচুর না হয়, সেজন্য কেপিআই হিসেবে আপগ্রেড করার চেষ্টা করছি। যাতে এটার নিরাপত্তা বাড়ে। মেট্রোরেলকে জরুরি সেবা হিসেবে ঘোষণা করার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। যাতে করে কেউ এভাবে সার্ভিসটাকে ব্যাহত করতে না পারে।
মেট্রোরেলে ভাঙচুর বা ক্ষতিসাধনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে সড়ক উপদেষ্টা বলেন, যারা দেশকে পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করেছে, তাদের পক্ষে এ ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। এটা দুষ্কৃতকারীদের কাজ। আপনাদের কাছে তাদের ভিডিও আছে, ফুটেজ আছে, আমরা এর জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ‘জনপ্রত্যাশার সরকার’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পরই প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আমার প্রথম কাজ মেট্রোরেল চালু করা। সেটা আমরা করেছি। এখানে বোর্ড পুনর্গঠন করতে হয়েছে। বোর্ডের সভা ছিল, কিছু দাবি–দাওয়া ছিল, এগুলো আমরা দেখেছি। এর আগে ১৭ আগস্ট এটা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মেট্রোরেলের কিছু কর্মকর্তা–কর্মচারীর জন্য সেটা চালু করা সম্ভব হয়নি। এটা বড় অন্যায় কাজ করেছে। তিন লাখ যাত্রীকে জিম্মি করে কোনো দাবি আদায়ের চেষ্টা শুভ লক্ষণ নয়।
মেট্রোরেলের বন্ধ স্টেশনগুলো কবে চালু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তিন–চার দিন আগে মেট্রোরেলের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করেছি। অন্যান্য লাইনগুলো চালুর ব্যাপারে আমরা কাজ করছি। আজ (রবিবার) বিকেলে জাপানের রাষ্ট্রদূত আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। কাজীপাড়া এবং মিরপুর ১০ স্টেশন কীভাবে চালু করা যায় সে ব্যাপারে আলাপ হবে।
মেট্রোরেলের এমডিকে বলেছি ক্ষয়ক্ষতি কী হয়েছে এটা নির্ধারণ করে টাইম লাইন দিতে। মিরপুর–১০ ও কাজীপাড়া স্টেশন অতি দ্রুত সংস্কার করা হবে এবং এ ব্যাপারে জাপানের রাষ্ট্রদূতের কাছে সহায়তা চাওয়া হবে।’
এ সময় মেট্রোরেলের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে মেট্রোরেলকে এসেনসিয়াল সার্ভিস হিসেবে ঘোষণা করা এবং কেপিআই আপডেট করার ব্যাপারে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা প্রদান করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা।
এ সময় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিকসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।