ধুমঘাট ব্রিজ থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে গেলে সামনে পড়ে ফেনীর ফাজিলপুর এলাকা। এ এলাকার দৌলতপুর গ্রামে আছে একটি বাজার। সেই বাজারে এখনও কোমরপানি। এখানেই মুদি দোকান আছে চল্লিশোর্ধ্ব আবদুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘কয়েক লাখ টাকার জিনিস ছিল দোকানে। পানি উঠে সব জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে। বিক্রি করার মতো এখন আর কিছু নেই। বাড়িতে গিয়ে রান্না করে খাব, সেই ব্যবস্থাও নেই। পুরো বাড়িতে এখনও কোমরপানি।’
মুহুরীগঞ্জ রহমানীয়া কমিউনিটি সেন্টারে থাকা সালেহা বেগম জানালেন আরেক সংকটের কথা। তিনি বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে আসার সময় ঘরে থাকা টাকা নিয়ে এসেছিলাম। তবে সেই টাকা দিয়ে যে কিছু কিনে খাব, নেই সেই সুযোগ। ক্ষুধার যন্ত্রণায় আমার সন্তান দুটি সারাদিনই কাঁদে।’
বিধ্বস্ত জনপদ ফেনীর এমন করুণ চিত্র এখন প্রতি ঘরে। যাদের কাছে খাবার আছে, তাদের রান্না করার ব্যবস্থা নেই। আর যাদের কাছে টাকা আছে, তাদের কোনো কিছু কেনার সুযোগ নেই। কারণ ছাগলনাইয়া, পরশুরামসহ ফেনীর অন্তত চারটি উপজেলায় এখনও রয়ে গেছে কোমরপানি।
ফেনী সদরের মাস্টারপাড়া এলাকায় ত্রাণ নিতে আসা অনিতা ভৌমিক জানান, শাশুড়ি, জা, দেবর, ছেলেমেয়েসহ আটজন সদস্য নিয়ে গত বুধবার রাত ৩টায় আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন তিনি। পানি বাড়তে থাকায় ঘরের দরজাও বন্ধ করতে পারেননি তিনি। এখন ঘরে গিয়ে দেখেন স্রোতের পানিতে সব জিনিস ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তাঁর ৩০ বছরের সংসার এক রাতেই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
ধুমঘাট ব্রিজ পেরিয়ে আধা কিলোমিটার সামনে সমিতি বাজার এলাকায় মহাসড়কের ওপর ১৫ থেকে ২০ জন নারী–পুরুষ ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন। এখান থেকে আরও দুই কিলোমিটার সামনে গিয়ে মুহুরীগঞ্জ বাজার এলাকায় দেখা যায় মহাসড়কের ওপর জটলা বেঁধে আছে শত শত লোক। বাজারের পূর্ব পাশে রহমানিয়া কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছে বানবাসী প্রায় এক হাজার মানুষ।
আশ্রয়কেন্দ্রে আসা ফেনীর শিবপুর গ্রামের রোকেয়া বেগম জানান, তাঁর ৬টি গরু, ১০টি মুরগি বানে ভেসে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফেরার আর কোনো পথই নেই। পুরো ঘর পানিতে ভাসছে। নষ্ট হয়ে গেছে সব জিনিসপত্র। আলাউদ্দিন নামের আরেক বাসিন্দা জানান, বন্যায় মুহুরীগঞ্জ, ফাজিলপুর, শিবপুর এলাকার প্রায় সব গবাদি পশু মারা গেছে। তিনি বলেন, ‘পেশায় আমি রাজমিস্ত্রি। বছর দশেক আগে সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে একটি নতুন বাড়ি করেছি। এখন বন্যার পানিতে শেষ হয়ে গেছে সব।’ ফেনীর ধলিয়া ইউনিয়নের মাছিমপুর গ্রামের বাসিন্দা পলাশ নাথ বলেন, তাদের বাড়ি থেকে ধনিয়া বাজার দেড় কিলোমিটার দূরে। এলাকার ঘরবাড়িতে এখনও হাঁটুপানি। পরিবারের জন্য বাজার করতে গিয়ে সব দোকান বন্ধ পেয়ে খালি হাতে ফেরেন তিনি। ত্রাণ ছাড়া কোনো উপায় দেখছেন না।
ফেনী নদী তরবর্তী মিরসরাইয়ের করেরহাট ইউনিয়নের করেরহাট বাজারের ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম জানান, মানুষের হাতে টাকা থাকলেও বাজারে নিত্যপণ্যের সংকট রয়েছে। একটি মোমবাতিও মিলছে না। কয়েকদিন গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় দোকানিরা পণ্যও আনতে পারছেন না। ধুম ইউনিয়নের গৃহিণী বীণা রানী জানান, ঘর থেকে পানি সরে যাওয়ায় চার দিন পর বাড়িতে এসেছেন তিনি। তবে বন্যার পানিতে সব নষ্ট হয়ে যাওয়ায় রান্নার জন্য বাজারে গিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার খোঁজেন তিনি। কোথাও পাননি গ্যাসের সিলিন্ডার। গতকাল দুপুরে এক ব্যক্তি তাদের কয়েক প্যাকেট খাবার দিয়েছে। সেটি খেয়ে আছেন এখনও। রাতে কী খাবেন জানেন না তিনি।
ফেনীর সহদেবপুর এলাকার বাসিন্দা সুমন দেবনাথ জানান, তাঁর মুদি দোকান পানিতে ডুবে প্রায় ৩ লাখ টাকার মালপত্র নষ্ট হয়েছে। নষ্ট হয়েছে বসতঘরে থাকা নগদ টাকাসহ জিনিসপত্র। বন্যা তাঁকে পথে বসিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
ফেনীর দৌলতপুর এলাকার বাসিন্দা মো. ইয়াছিন জানান, আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পাঁচ দিন পর বাড়িতে গিয়ে দেখেন বন্যার পানিতে জায়গাজমির কাগজপত্রসহ সব জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। কাঁচাবাজার কিনতে বারইয়ারহাটে এসে দেখেন বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সব পণ্য। পরে মুড়ি, চিড়া আর গুড় নিয়ে ঘরে ফেরেন ইয়াছিন।