রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে ব্যক্তিগত প্রাইভেট কারে ত্রাণ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসে এসে থামেন ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম। ঢাকায় তার একটি ব্যক্তিগত মাছের ফার্ম রয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, আকস্মিক বন্যায় ডুবছে আমার দেশ। এমতাবস্থায় বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবারই দায়িত্ব। তাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে বন্যার্তদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছি। ভারতের আধিপত্যেবাদের বিরুদ্ধে আমরা প্রত্যেক্যেই একেকটা দুর্গ হব। এবং এই যে আমরা তাদের প্রতিহিংসার বিপরীতে এক হয়েছি সেটাই প্রমাণ করে আগামীর বাংলাদেশ হবে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র।
ব্যবসায়ী আব্দুস সালামের মতো নানা শ্রেনী পেশার মানুষ গত তিনদিন ধরে শিক্ষার্থীদের ডাকে সাড়া দিয়ে ঢাবির টিএসসিতে ত্রাণ নিয়ে আসছেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা এই গণত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচিতে প্রথম দিনেই ভালো সাড়া পায় শিক্ষার্থীরা। পরে শুক্রবার দ্বিতীয় ও গতকাল শনিবার তৃতীয় দিনের কর্মসূচিতে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছে শিক্ষার্থীরা।
গণত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচিতে বৃহস্পতিবার প্রথম দিনেই নগদ টাকা সংগ্রহ হয় ২৯ লাখ। পরদিন শুক্রবার নগদ সংগ্রহ হয় ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংক একাউন্টে আসে আরো কয়েক লাখ টাকা। গতকাল শনিবার সকাল ১০ টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত গণত্রাণ কর্মসূচি চলে। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত আর্থিক সংগ্রহের পরিমাণ জানা যায়নি। সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সাথে কথা বলে ধারণা করা হয় এদিন আগের দিনের চেয়ে অনেক বেশি সংগ্রহ হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ও আশপাশের পুরো এলাকা ব্লক ছিল। ত্রাণের গাড়িতে পুরো এরিয়ায় যানজট দেখা দেয়। টিএসসির মূল ফটক থেকে শুরু করে ভেতরের ক্যাফেটেরিয়া ও টিএসসির অভ্যন্তরিন মাঠে এদিন অন্তত ২ হাজার ভলান্টিয়ার কাজ করতে দেখা যায়। তা সত্ত্বেও ত্রাণ নিতে হিমসিম খেতে হয়েছিল শিক্ষার্থীদের। টিএসসির ভেতরের ফটকের সামনে নগদ অর্থ সংগ্রহের বুথে গিয়ে দেখা যায় অনেক মানুষ সারিবদ্ধ হয়ে টাকা দিচ্ছেন। লাইন ধরে টাকা দেওয়ার এমন দৃশ্য হয়তো ঢাবি শিক্ষার্থীরা আগে দেখেনি।
সবুজ নামের এক ভলান্টিয়ার বলেন, সারাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বন্যার্তদের সহায়তায় গাড়িতে গাড়িতে করে ত্রাণ নিয়ে আসছেন মানুষ। সত্যি বলতে বাংলাদেশের মানুষের মন যে এত বড় তা এর আগে বুঝতে পারিনি। সবুজ বলেন, আমরা প্রায় ২ হাজার ভলান্টিয়ার এখানে কাজ করেও হিমসিম খেতে হচ্ছে। এত বিপুল পরিমাণ ত্রাণ নিয়ে আসছেন মানুষ।
সরেজমিনে কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আশপাশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের শিক্ষার্থীরাও ভলান্টিয়ার হিসেবে ত্রাণ সংগ্রহ ও প্যাকেটিংয়ের কাজ করছেন। শুধু শিক্ষার্থী নয়, চাকরিজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষও এদিন ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। এমনই একজনের সাথে দেখা হয় টিএসসির ভেতরের মাঠে।তিনি এখন টিভির সাংবাদিক ফরহাদ। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাংবাদিকতার বাইরে আমাদের আসলে খুব বেশি কিছু করার থাকে না। কিন্তু এই অসহায় মানুষদের আর্তনাদ দেখে আমাদেরও হৃদয় কাঁদে। তাই আজকে অফ ডে›তে শিক্ষার্থীদের সাথে কাজ করতে ছুটে এসেছি।
টিএসসির এই গণত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচির তদারকির দায়িত্বে ছিলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনিই প্রথম এই কর্মসূচির ঘোষণা দেন। শুক্রবার রাতে ত্রাণ প্যাকেটিং শেষে শনিবার ভোররাতে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা দেন হাসনাত। এদিন তিনি কুমিল্লায় বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। আজ রোববার থেকে বন্যকবলিত এলাকায় গণরান্না কর্মসূচির ঘোষণা দেন হাসনাত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক বার্তায় তিনি এ ঘোষণা দেন। এতে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন হাসনাত।
এদিকে বৃহস্পতিবার ত্রাণ নিয়ে বন্যাকবলিত এলাকা ফেনী গিয়ে নিখোঁজ হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৩ জন সদস্য। সর্বশেষ গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তাদের খোঁজ পাওয়া যায়। সূত্রমতে, বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে ফেনীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের একটি টিম। ফেনী গিয়ে কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধার কাজ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে ফেনীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে নিখোঁজ হয় ৩ সদস্যের সেই টিম। যেখানে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দুই শিক্ষার্থী ও স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষার্থী।
নিখোঁজ হওয়া ওই তিন শিক্ষার্থীর খোঁজ পাওয়া যায় গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে। খোঁজ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৮–১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোস্তফা আকিল। তিনি বলেন, ওই তিন শিক্ষার্থীর নাম সাকিব, মনোয়ার ও রিয়াদ। তারা ফেনীর একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যাওয়ায় নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরে শনিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে শহরের দিকে এসে আমার সাথে যোগাযোগ করে।
বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সারাদিন কাজ করার পর সারারাতও টিএসসিতে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেন কয়েকশো শিক্ষার্থী। গতকাল শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থীকে কাজ করতে দেখা যায়। এসময় শিক্ষার্থীরা ্রদিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকাগ্ধ, ্র আজাদি আজাদিগ্ধ আপোষ না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রামগ্ধ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে ভলান্টিয়ারদের উজ্জীবিত করতে দেখা যায়।
শুধু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের টিএসসি কেন্দ্রীক ফান্ড সংগ্রহ নয়, এর বাইরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, ইনস্টিটিউট, অনুষদ, হলে ও ব্যাচভিত্তিক শিক্ষার্থীরা আলাদা আলাদা ফান্ড সংগ্রহ করেছে। গত তিনদিনে শিক্ষার্থীরা বিপুল পরিমাণ ত্রাণ সংগ্রহ করে অনেক কিছু বন্যা কবলিত এলাকায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। শনিবার সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্তও প্রতিটি হলে হলে ত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচি চলমান ছিল।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলের শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ত্রাণ সামগ্রী জমা দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যবহার্য কাপড়, শুকনো খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এতে জমা দিচ্ছেন। প্রায় প্রতিটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা আলাদা আলাদাভাবে ফান্ড সংগ্রহ করেন। প্রতিটি বিভাগ থেকেই নূন্যতম ২ লাখ টাকার ফান্ড সংগ্রহ করা হয়েছে।
গত শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও সদস্যদের একদিনের আয় বন্যার্তদের জন্য দান করার ঘোষণা দিয়েছেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তার ফেসবুকে প্রথম মাসের পুরো স্যালারি বন্যার্তদের জন্য দান করার ঘোষণা দেন। এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র–শিক্ষক এগিয়ে আসে বানভাসিদের সাহায্যে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এরিয়ার বাইরে গিয়েও আশপাশের নিউমার্কেট এলাকা, শাহবাগ, চানখারপুল, পলাশিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় বাজার থেকে ফান্ড সংগ্রহ করেছে শিক্ষার্থীরা। গত তিনদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ কাজে সময় দেয় শিক্ষার্থীরা। এছাড়া টিএসসিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সংগ্রহ করা হয় বিপুল পরিমাণ ত্রাণ। এতে প্যাকেটিংয়ের কাজে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে অন্তত ৫০০ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের এমন উদ্যোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসা করছেন নেটিজেনরা। কেউ কেউ বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনো ঘুমায় না। জাতির প্রয়োজনে সবসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, আছে, থাকবে।
শুধু ত্রাণ সংগ্রহ করা ও তা বন্যার্তদের মাঝে পৌঁছে দেয়াই নয় বরং বন্যার্তদের উদ্ধার কাজেও সাহায্য করেছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা আলাদা আলাদা টিম গঠন করে স্পিড বোট কিংবা কাঠের বোট নিয়ে বন্যাকবলিত এলাকায় গিয়ে বানভাসিদের উদ্ধারের কাজ করেন।