নগরীতে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছে সিডিএ। একই সময়ে নির্মিত হলেও প্রকল্প ব্যয়ে ব্যাপক ব্যবধান। তিনটি ফ্লাইওভার ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। কিন্তু যানজট নিরসনে সুফল মিলছে না। ফ্লাইওভার থাকে ফাঁকা আর নিচে প্রচণ্ড যানজট। নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিযোগ পছন্দের লোক দিয়ে গ্রহণযোগ্য ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়াই ফ্লাইওভারগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। দুই তিন দফায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। ফ্লাইওভার নির্মাণে অনিয়মের মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বিগত সরকারের অনেকেই। এতে নির্মাণ কাজে সরকারি অর্থের নয়ছয় হয়েছে। অদক্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে নির্মাণকাজ করায় বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় গার্ডার পড়ে ১৬ জন পথচারী নিহত হন।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, চট্টগ্রাম নগরীতে যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করে তাতে ফ্লাইওভার নির্মাণের কোনো প্রয়োজন নেই। নগরীতে অনেকগুলো বিকল্প সড়ক আছে। শুধু ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নত করে এবং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জংশনে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করলে যানজট নিরসন হয়ে যেত। এক কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণের টাকা দিয়ে সবগুলো ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা সম্ভব হতো। ফ্লাইওভার নির্মাণের মাধ্যমে মন্ত্রণালয় ও সিডিএ’র সংশ্লিষ্ট কিছু লোক রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আর্থিক সুবিধা নিয়েছে। এতে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হয়েছে। এখন তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা প্রয়োজন।
এসব ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণের সময় সিডিএতে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের দায়িত্বে ছিলেন প্রকৌশলী মো. শাহীনুল ইসলাম খান। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, ‘এ ধরনের ফ্লাইওভার নির্মাণের আগে ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে হয়। প্রকল্প অনুমোদনের জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি বাধ্যতামূলক। এতে প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা, পরিবেশ, কী পরিমাণ গাড়ি চলাচল করবে তা নির্ণয় করা হয়। কিন্তু সিডিএর প্ল্যানিং বিভাগকে যুক্ত না করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে যেনতেনভাবে ফিজিবিলিটি স্টাডি দেখিয়ে এসব ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ফ্লাইওভার দিয়ে ৩ শতাংশ প্রাইভেট কার চলবে বলে উল্লেখ করা হয়।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, প্রতিটি মেগা প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। দফায় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ও বরাদ্দ বাড়ানো দুর্নীতির একটি অপকৌশল। ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়াই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ঠিকাদার নিয়োগে স্বচ্ছতা আছে—তা জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই। ফলে এসব ফ্লাইওভার প্রকল্পের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাস বড়ুয়া ইত্তেফাককে বলেন, ফ্লাইওভারসহ মেগা প্রকল্পের জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি জরুরি। যেনতেনভাবে লোক দেখানো ফিজিবিলিটি স্টাডি দেখিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। জনগণের টাকায় বড় লোকের গাড়ি চলতে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। আর গরিব লোকের গণপরিবহন চলবে নিচ দিয়ে। ফ্লাইওভারের কারণে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। নির্মিত ফ্লাইওভারগুলোর বিষয়ে সিডিএর কাছে তথ্য চাওয়া হবে। তদন্তসাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
সিডিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান লালখানবাজার মুরাদপুর এবং বিমানবন্দর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ফ্লাইওভারের প্রকল্প পরিচালক। তিনি বলেন, চুয়েটের মাধ্যমে এই দুটি প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়েছে।
২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কদমতলী ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করা হয়েছে। ১১০০ মিটার দীর্ঘ এবং ৮ দশমিক ৫ মিটার প্রশস্ত এই ফ্লাইওভারটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫৮ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার টাকা। অর্থাত্ প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে প্রায় ৫২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মুরাদপুর জিইসি লালখান বাজার ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। এই ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার আর প্রস্থ ১৬ দশমিক ৫ মিটার। ৪ লেন বিশিষ্ট এই প্রকল্পে ১ কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। এটির দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার আর প্রস্থ ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৬৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ২০১০ থেকে ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার। এটির দৈর্ঘ্য ১৩৩১ দশমিক ৬০ মিটার আর প্রস্থ ২৪ মিটার। এই প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ১৪৪ কোটি ১৮ লাখ ৭ হাজার টাকা। প্রকল্পটিতে প্রথমে ১০৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল।
লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ প্রকল্পে দুই–তিন দফায় নির্মাণ ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখনো র্যাম্প তৈরির কাজ চলছে। র্যাম্প তৈরি নিয়ে চলছে জটিলতা। ফ্লাইওভারের কয়েকটি স্থানে ফাটল দেখা দেওয়ায় একটি সংসদীয় কমিটি করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কমিটি বাতিল হয়ে গেছে।
চালু হওয়া ফ্লাইওভারের মধ্যে রয়েছে কদমতলী ফ্লাইওভার, বহদ্দারহাট জংশন ফ্লাইওভার ও মুরাদপুর জিইসি মোড় ফ্লাইওভার। নির্মিত ফ্লাইওভারগুলোর মধ্যে কদমতলী ফ্লাইওভারের যানজট নিরসনে কোনো সুফল মিলছে না। এই ফ্লাইওভারটি নির্মিত সড়কের পরিসরও ছোট। ফ্লাইওভার বিদ্যমান সড়কের অধিকাংশ জায়গাজুড়ে নির্মিত হওয়ায় সড়কে নিত্য যানজট লেগে থাকে।
কদমতলী বিআরটিসি থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত ফ্লাইওভারের নির্মাণে বলা হয়েছিল এই ফ্লাইওভার নির্মিত হলে আগ্রাবাদ, বারিক বিল্ডিং, দেওয়ানহাট হতে আগত যানবাহনগুলো এই ফ্লাইওভারের মাধ্যমে অতি সহজে নিউমার্কেট এলাকায় প্রবেশ করবে। কিন্তু ফ্লাইওভারে কোন র্যাম্প নির্মিত না হওয়ায় আগ্রাবাদ বারিক বিল্ডিংয়ের গাড়ি চলাচল করতে পারছে না। ফ্লাইওভারটি প্রায় সময়ই ফাঁকা থাকে।
মুরাদপুর সিইসি মোড় ফ্লাইওভার এক প্রাপ্ত পড়েছে লালখান বাজার ও অপর প্রান্ত পড়েছে বায়েজিদ সড়কের নাছিরাবাদ এলাকায়। ফ্লাইওভারের নাছিরাবাদের র্যাম্পটি দুই নম্বর গেট এলাকায় প্রায় ৮০ মিটার উঁচুতে নির্মিত। এই র্যাম্প দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল করতে পারে না। এতে নাছিরাবাদ শিল্প এলাকা থেকে বন্দরমুখী পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানগুলো ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাচল করছে। আবার বহদ্দারহাট থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাক কাভার্ড ভ্যানসহ অন্যান্য যানবাহন দুই নম্বর গেট হয়ে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাচল করছে। যার কারণে নগরীর ব্যস্ততম দুই নম্বর গেট এলাকায় নিত্য যানজট লেগে থাকে।
বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারে বাদুরতলামুখী র্যাম্প নির্মাণ করা হয়নি। এই ফ্লাইওভার নির্মাণে অদক্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি নির্মাণের সময় বহদ্দারহাট এলাকায় গার্ডার ভেঙে গিয়ে তাতে চাপা পড়ে ১৬ জন পথচারী নিহত হন। পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়।