ছাত্র আন্দোলনের কারণে দেশ অস্থিতিশীল থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষি খাত। ঝুঁকির কারণে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় দাম পাননি কৃষকরা। ক্ষতি কাটিয়ে তারা আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় আছেন। তবে কৃষকের পাশে নেই কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কোনো সংস্থা। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ শুরু করলেও কৃষি খাত অনেকটাই স্থবির। কৃষির ১৮ দপ্তরের বেশির ভাগ কার্যালয়ে চলছে অচলাবস্থা। অনেক দপ্তরের আওয়ামীপন্থি দুর্নীতিবাজ মহাপরিচালক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চলে গেছেন আত্মগোপনে। সব দপ্তরেই দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি বঞ্চনা ও হয়রানির অভিযোগ এনে প্রতিদিন একদল কর্মকর্তা–কর্মচারী বিক্ষোভ, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি পালন করছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা।
এ পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক, গবেষণা এবং মাঠ পর্যায়ের কৃষি কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। এতে কৃষকরা পাচ্ছেন না কাঙ্ক্ষিত সেবা। সার, বীজ, প্রণোদনা বিতরণ, রোগবালাই দমনে দিকনির্দেশনা, এমনকি মাঠ দিবসও বন্ধ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষির সংকট দ্রুত না কাটলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। ফলে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দ্রুত এ খাত সচল করার পক্ষে মত দিয়েছেন তারা।
ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মাঠে নামানো কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার ও তার স্বামী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এরই মধ্যে বাতিল করেছে সরকার। সচিব চাকরি খোয়ালেও এখনও বহাল তবিয়তে আছেন অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা।
রাজধানীর ফার্মগেটের খামারবাড়ি ‘কৃষির বাতিঘর’। এখানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মাধ্যমে সারাদেশে ২৪ হাজারের বেশি কর্মকর্তা–কর্মচারীর কর্মকাণ্ড চলে। সরকার পতনের পর থেকেই খামারবাড়িতে বিরাজ করছে অস্থিরতা। মহাপরিচালকের পদত্যাগ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবিতে নিয়মিত হচ্ছে মিছিল–সমাবেশ। সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিএইর সবচেয়ে প্রভাবশালী বিভাগ প্রশাসন ও অর্থ উইং।
নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন, কেনাকাটাসহ সবকিছুতেই প্রভাব বিস্তার করে এ বিভাগ। প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের পরিচালক জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে এ উইংয়ের একটি সিন্ডিকেট সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। জয়নুল আবেদীন সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারের ঘনিষ্ঠজন। ফলে ডিএইর বর্তমান মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাসও জয়নুলের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন শাখার বাইরে যেতে পারেননি। গত ৪ আগস্ট ছাত্র–জনতার আন্দোলনকে জঙ্গি, সন্ত্রাসী উল্লেখ করে রাস্তায় নামে কৃষিবিদের বড় একটি অংশ। খামারবাড়ির সামনে এ আয়োজনের নেতৃত্বে ছিলেন মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস। কর্মকর্তা–কর্মচারী সবাইকে কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করতে কলকাঠি নাড়েন পরিচালক জয়নুল আবেদীন। খামারবাড়ির অনিয়ম–দুর্নীতি নিয়ে এর আগে সমকালে একাধিক খবর প্রকাশিত হলেও বারবার পার পেয়ে যান অভিযুক্তরা। ডিএই মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস এক বছর মেয়াদ শেষে বর্তমানে চুক্তিতে আছেন। আগামী সেপ্টেম্বরে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। পদত্যাগের দাবিতে কর্মকর্তা–কর্মচারীরা আন্দোলন করলেও তিনি তা এড়িয়ে যাচ্ছেন। বাদল চন্দ্র বিশ্বাস অফিসে না আসায় সব কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
কৃষি খাতের উন্নয়ন–অগ্রগতি, উদ্ভাবনসহ নতুন তথ্য কৃষকসহ সব মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) কাজ। এআইএসের পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায়ের নানা অনিয়ম–দুর্নীতির খবর দীর্ঘদিন ধরে গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও নেওয়া হয়নি ব্যবস্থা। কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধু হওয়ার সুবাদে উল্টো দুর্নীতির তথ্যদাতা সন্দেহে অন্য কর্মকর্তাদের বদলি ও শাস্তি দেওয়া হয়। ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও মিছিলে শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে নানা স্লোগানের ব্যানার, ফেস্টুন এআইএসের গাড়িতে করে সরাসরি সরবরাহ করতে দেখা যায় সুরজিতকে। এত কিছুর পরও সুরজিত সাহা এখনও বহাল। তবে বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা–কর্মচারীর ভয়ে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সরকার পতনের পর থেকেই গাজীপুরের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মহাপরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার আত্মগোপনে। অন্যদিকে অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ তুলে মহাপরিচালকের অপসারণ দাবিতে এক সপ্তাহ ধরে বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা–কর্মচারী ও শ্রমিকরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। মহাপরিচালক অফিসে না আসায় প্রশাসনসহ সার্বিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আট শতাধিক বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা–কর্মচারী ও তিন সহস্রাধিক শ্রমিক এখনও জুলাইয়ের বেতন–ভাতা পাননি। নিয়ম মেনে অফিসে হাজিরা দিলেও কোনো কাজ করতে পারছেন না তারা। অবিলম্বে ড. দেবাশীষের অপসারণ ও শাস্তি দাবি করেন বারির ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ টি এম হাসানুজ্জামান।
২০২১ সালের ২১ অক্টোবর মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান ড. দেবাশীষ। এ পদে তাঁর মেয়াদ শেষ হলে ২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি দু’বছরের জন্য ফের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, যোগ দেওয়ার পর থেকে তিনি বিধিবিধান না মেনে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্য করেছেন। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দ্বিমত পোষণ করলে বদলিসহ নানা নির্যাতন করা হতো।
সরকার পতনের পর আর অফিস করেননি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার। গতকাল রাতে তার চুক্তিভিত্তক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। নির্ধারিত মেয়াদ শেষে দু’দফা চুক্তি ভিত্তিতে এ পদে ছিলেন তিনি। কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারের স্বামী হওয়ায় প্রভাব খাটিয়ে বখতিয়ার বিএআরসিতে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন বলে কর্মকর্তাদের অভিযোগ। সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমানের ভাগ্নি ওয়াহিদা আক্তার ছিলেন শেখ হাসিনার পিএস। কয়েক বছর ধরে মূলত ওয়াহিদা–বখতিয়ার দম্পতি পুরো কৃষি খাতকে কুক্ষিগত করেন বলে অভিযোগ আছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ভুক্ত আরেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরই)। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ড. আবদুল আউয়ালের বিরুদ্ধে দুর্নীতি–অনিয়মের অভিযোগ তুলে গত ৬ আগস্ট থেকেই আন্দোলনে রয়েছে কর্মকর্তা–কর্মচারীর বড় একটি অংশ। গত ৪ আগস্ট ছাত্র–জনতার আন্দোলনের বিপক্ষে মানববন্ধন–বিক্ষোভে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা–কর্মচারীদের জোর করে অংশগ্রহণ করানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর ৮ আগষ্ট কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর স্বেচ্ছা অবসরের চিঠি দেন। তবে এ সংস্থার প্রধান দাবি করেছেন, তাঁর ওই চিঠিতে কর্মকর্তাদের একটি অংশ জোর করে সই নিয়েছে। অবসরের চিঠিটি বাতিলের জন্য একই দিন সচিব বরাবর আরও একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে আগের অবসরের চিঠিটি আমলে না নেওয়ার অনুরোধ জানান শাহজাহান কবীর। অবশ্য ৮ আগস্টের পর থেকে তিনিসহ একাধিক কর্মকর্তা আতঙ্কে অফিসে যাচ্ছেন না।
দুর্নীতিতে অভিযুক্ত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান (বিএডিসি) আবদুল্লাহ সাজ্জাদ রাতারাতি খোলস বদলে এখন বিএনপিপন্থি বনে গেছেন। শুধু তাই নয়, গত এক সপ্তাহে তিনি অর্ধশত কর্মকর্তা–কর্মচারীকে বদলি করে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে পদায়ন করেছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ফেরদৌসী ইসলাম ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ সরকার পতনের পর থেকেই আত্মগোপনে।
কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংস্থাগুলোতে কিছু কিছু লোকের উত্থান শুরু হয়েছে। এতে অনেক কর্মকর্তা ভয়ে অফিস করছেন না। ভয় দূর করতে তাদের অন্য দপ্তরে বদলি করা দরকার। এ ছাড়া দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে দ্রুত অপসারণ করে নতুন পদায়ন করলেই কৃষির অচলাবস্থা কেটে যেতে পারে।
নতুন কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান সমকালকে বলেন, আমি সবে অফিস শুরু করেছি। কৃষির দপ্তরে দপ্তরে অস্থিরতার বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেব। যেভাবে করলে কাজের পরিবেশ ফিরে আসবে, নতুন কৃষি উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শ করে খুব শিগগির সে ব্যবস্থা নেব।