ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
নতুন এই সরকার গঠনের পর থেকে একে একে সরে যাচ্ছেন আওয়ামী সরকারের আমলের সুবিধাভোগীরা। ইতোধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো–ভিসি, প্রক্টর, প্রভোস্টসহ বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যানগণ পদত্যাগ করেছেন। সর্বশেষ গতকাল রোববার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো–ভিসি, কবি নজরুল কলেজ, তিতুমীর কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল। এছাড়া কয়েকটি পদে রদবদলও করা হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ভিসি, প্রো–ভিসিসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও কলেজের অধ্যক্ষদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনও করছেন শিক্ষার্থীরা।
সকালে চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর কাজী শহীদুল্লাহ। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠান। কাজী শহীদুল্লাহ বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় আছেন। গত বছর থেকে তিনি সেখানে আছেন। মাঝে একবার দেশে আসেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে ইউজিসির চেয়ারম্যানের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য প্রফেসর মুহাম্মদ আলমগীর।
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, কাজী শহীদুল্লাহ অসুস্থর কারণে দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এ জন্য তিনি ইস্তফা দিয়েছেন। পদত্যাগপত্রে কাজী শহীদুল্লাহ লিখেছেন, ‘আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ২০২৩ সালের ২৮ মে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান পদে যোগদান করি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অফিস আদেশ অনুযায়ী গত বছরের ২০ আগস্ট থেকে চিকিৎসার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছি। অস্ট্রেলিয়ার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ এবং বর্তমান শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় কমিশনের চেয়ারম্যান পদের দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করছি।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক প্রফেসর কাজী শহীদুল্লাহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্বও পালন করেছেন।
ইউজিসির নতুন সচিব ফখরুল ইসলাম: ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামানকে বদলি করে তার স্থলে সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির রিসার্চ সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন বিভাগের পরিচালক ড. মো. ফখরুল ইসলাম। ইউজিসি থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
অফিস আদেশে বলা হয়েছে, ইউজিসির চাকরি প্রবিধানমালা, ১৯৮৭ এর ২১ ধারা মোতাবেক কমিশনের স্বার্থে পদ ও বিভাগে সাময়িকভাবে বদলি করা হয়েছে। ফেরদৌস জামানকে সচিব পদ থেকে বদলি করে প্রতিষ্ঠানটির রিসার্চ সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন বিভাগের পরিচালক করা হয়েছে। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে এবং পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে অফিস আদেশে বলা হয়েছে।
বাকৃবি ভিসির পদত্যাগ: আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভিসি প্রফেসর ড. এমদাদুল হক চৌধুরী ক্যাম্পাস ছেড়েছিলেন। তবে তার পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। অবশেষে গতকাল তিনি পদত্যাগ করেছেন। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে রোববার ড. এমদাদুল হক চৌধুরী সচিবালয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাকৃবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেনর ড. মো. আসাদুজ্জামান সরকার। এছাড়া বাকৃবির উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কো–অর্ডিনেটর প্রফেসর ড. আবু হাদী নূর আলী খান, ট্রেজারার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. সাইদুর রহমান, ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. হারুন–অর–রশীদ, সহযোগী ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আফরিনা মোস্তারি, পরিবহন শাখার পরিচালক প্রফেসর ড. রফিকুল আলম পদত্যাগ করেছেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির পদত্যাগ: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমান গতকাল পদত্যাগ করেছেন। ড. মশিউর রহমান নিজেই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, রোববার সকালে তিনি পদত্যাগ পত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির পদত্যাগ: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর এ এফ এম আবদুল মঈন ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন। রোববার তিনি রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বরাবর পদত্যাগপত্রটি পাঠান। পদত্যাগপত্রে তিনি বলেন, আমি ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে যোগদান করি। যোগদানের পর আমি আমার অভিজ্ঞতা, সততা, নৈতিকতা, দক্ষতা ও আইন মেনে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করি। পদত্যাগপত্রে ভিসি বলেন, বর্তমানে আমি আমার ব্যক্তিগত কারণে ভিসির পদ থেকে পদত্যাগের জন্য আপনার কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করলাম।
এছাড়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. কামরুল আলম খান পদত্যাগ করেছেন।
শাবিপ্রবি ট্রেজারার: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ভিসির পর পদত্যাগ করেছেন ট্রেজারার প্রফেসর আমিনা পারভীন। শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর সূত্রে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
জাবি প্রো–ভিসির পদত্যাগ: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রো–ভিসি (শিক্ষা) প্রফেসর মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ পদত্যাগ করেছেন। রোববার প্রেসিডেন্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে তিনি ইমেইলে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
আন্দোলনের মুখে তিন অধ্যক্ষের পদত্যাগ: শিক্ষার্থীদের চাপে পড়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ফেরদৌস আরা বেগম। রোববার অধ্যক্ষের রুমে শিক্ষার্থীদের দেওয়া পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন তিনি। দায়িত্বে থাকাকালীন রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা, হল বানিজ্য, অতিরিক্ত অর্থ আদায়, অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ক্যাম্পাসের সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমে বাধা দেওয়ায় বিভিন্ন সহশিক্ষা সংগঠনের নেতৃবৃন্দরাও তার উপর ক্ষুব্ধ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তিতুমীর কলেজ শাখার সমন্বয়করা বলেন, একজন কলেজ অধ্যক্ষ কীভাবে কোন আইনে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে তা বোধগম্য নয়। তিনি সরাসরি ছাত্রলীগের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করতেন। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা বা সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন ক্যাম্পাসে মার খেতো তখন অধ্যক্ষ চুপ করে থাকতেন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা দিতেন।
কবি নজরুল কলেজ: বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পদত্যাগ করলেন কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আমেনা বেগম। রোববার সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ভুয়া ভুয়া বলে স্লোগানে অধ্যক্ষকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করেন। এ সময় কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আমেনা বেগম শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সাদা কাগজে ‘আমি পদত্যাগ করলাম’ লিখে অধ্যক্ষের স্বাক্ষর ও সিলমোহর দিয়ে পদত্যাগ করেন।
সমন্বয়ক মেহেদী বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমাদের কলেজের চারজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন এবং শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তিনি আহত ও নিহত শিক্ষার্থীদের কোনো খোঁজখবর নেননি। এ ছাড়া দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের নেত্রী স্থানীয় পর্যায়ে ছিলেন। কলেজের নানা, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। আমাদের দাবির মুখে দুর্নীতিগ্রস্ত অধ্যক্ষ আমেনা বেগম পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ভিকারুননিসায় অধ্যক্ষসহ ২ জনের পদত্যাগ: ছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষসহ দুই শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন। রোববার শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে তারা পদত্যাগপত্রে সই করেন। পদত্যাগ করা দুজন হলেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী এবং কলেজ শাখার অধ্যাপক ও গভর্নিং বডির (কলেজ) সদস্য ফারহানা খানম। ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তাদের পদত্যাগপত্রে সই করার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
জানতে চাইলে প্রফেসর ফারহানা খানম বলেন, আমাকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিনি।
এর আগে সকাল ১০টায় রাজধানীর বেইলি রোডে ভিকারুননিসার মূল শাখার সামনে এ বিক্ষোভ করে তারা। এসময় তাদের হাতে শিক্ষকের সংস্কার, ফারহানার বহিষ্কার, ফারহানা, আর না আর না, ভিকারুননিসায় দুর্নীতি, মানবো না মানবো না–লেখা প্ল্যাকার্ড দেখা যায়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, অধ্যক্ষ কেকা চৌধুরী পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. ফারহানা খানমের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের হামলার সময় নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় দিতে সাহায্য করেননি। উল্টো তাদের টিসি দেওয়া এবং হেনস্তা করার হুমকি দেন। তাদের বিরুদ্ধে কলেজে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। এজন্য তাদের চাকরিচ্যুত করার দাবি জানিয়েছেন তারা