বন্যার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে নদীভাঙন। এতে সড়ক, দোকানপাট, বসতবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার এমনকি হাসপাতাল বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বহু স্থাপনা, পথঘাট, ঘরবাড়ি চলে গেছে নদীগর্ভে। আবার কোথাও উপজেলা সদর চিরতরে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। গবেষণা সংস্থা ও ভুক্তভোগী মানুষের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
নদীভাঙনের পূর্বাভাস নিয়ে কাজ করে থাকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। সংস্থাটি ‘নদীভাঙন পূর্বাভাস–২০২০’ নামে একটি গবেষণা করেছে।
তাতে বলা হয়েছে, এ বছর শুধু ব্রহ্মপুত্র–যমুনা ও গঙ্গা–পদ্মা এই দুই নদী অববাহিকায় ১৬টি স্থান ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে। দেশের ১২ জেলায় স্থানগুলো অবস্থিত। জেলাগুলো হচ্ছে– কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, রাজশাহী, পাবনা, ফরিদপুর ও মাদারীপুর।
সংস্থাটি বলছে, এবারের মৌসুমে ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ্মা–গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র–যমুনা নদী পাড়ে ভাঙন চলতে পারে। এতে ৩৬৫ বসতবাড়ি, ৫ হাজার ৪শ’ মিটার জেলা–উপজেলা–গ্রামীণ সড়ক, ৩২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৩ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ২৯ মসজিদ, ৩ হাটবাজার, ২ সরকারি ও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে যাবে। এসব জেলার অন্তত ২৪ হাজার মানুষ নদীভাঙনের কারণে বাস্তুচ্যুত হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে সাড়ে ৬শ’ এলাকা আছে নদীভাঙনপ্রবণ। এছাড়া ১৭শ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। এসবের মধ্যে ৬৫টি টার্গেট করে আমি সরেজমিন পরিদর্শনের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় কাজও শুরু করেছি। এ পর্যন্ত ৪১টি স্থান পরিদর্শন করেছি। তিনি বলেন, নদীভাঙন রোধে আমরা মন্ত্রণালয়ের সবাই মাঠে আছি। স্থান চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। দেশে ধারাবাহিকভাবে নদীর ভাঙন কমে আসছে।
স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পূর্বাভাস দেয়া জেলাগুলোর কয়েকটিতে এখনও বন্যা পরিস্থিতি অবনতিশীল, এরই মধ্যে কয়েকটিতে ভয়াবহ নদীভাঙন শুরু হয়েছে। এবারের বন্যা শুরু হয় ২৭ জুন। তিন দফা বন্যার দ্বিতীয়টি ১১ জুলাই এবং তৃতীয়টি ২০ জুলাই শুরু হয়েছে। অনেক স্থানে নদীগুলো দিয়ে বন্যার পানি হু–হু করে নামছে।
বাংলাদেশের নদীগুলো উজান থেকে বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত হয়। চার অববাহিকার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র সবচেয়ে বেশি প্রায় ৭০ শতাংশ পানি বহন করে উজান থেকে। এই নদীটি চীন–ভুটান–ভারত হয়ে বাংলাদেশের রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে মিলিত হয়েছে পদ্মায়। অপরদিকে ভারত থেকে গঙ্গা নদী প্রবেশ করেছে রাজশাহী হয়ে। এই নদীর বাংলাদেশে নাম পদ্মা। পদ্মা নদী নিজের পানির সঙ্গে যমুনার সব পানি বহন করে চাঁদপুরে মিলিত হয়েছে মেঘনায়।
এছাড়া সিলেট অঞ্চল থেকে শুরু আপার মেঘনা অববাহিকা। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি রাজ্যের পানি এই অববাহিকা বহন করে। দেশের পার্বত্য অববাহিকার কিছু পানিও এসে যুক্ত হয় মেঘনায়। ফলে বলতে গেলে চার অববাহিকার পানি মেঘনা বহন করে নিয়ে যায় বঙ্গোপসাগরে। সে কারণে মেঘনা এবং এর শাখা নদীগুলোতেও প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের শেষের দিকে যখন পানি নামতে শুরু করে তখন ভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। যদিও সিইজিআইএস এই নদীর ভাঙন নিয়ে কোনো পূর্বাভাস দেয় না।
এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় মাদারীপুরের শিবচরে নূরুদ্দিন মাদবরেরকান্দি গ্রামে এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় ভবনটি ভেঙে পদ্মায় বিলীন হওয়ার ঘটনা। ২০১৮ সালের ভাঙনে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার একমাত্র হাসপাতালের অর্ধেকের বেশি নদীতে চলে যায়। এ কারণে ওই হাসপাতালে বর্তমানে কোনো রোগী ভর্তি করা হয় না।
উপজেলার বাসিন্দারা কেবল আউটডোর সার্ভিস পাচ্ছে বলে জানান স্থানীয় নাগরিক ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রাজেশ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, তখন সারা দেশে এই ভাঙনের ঘটনা আলোচিত হয়। এরপর সরকার ওই এলাকা রক্ষায় পদ্মাতীরে জিওব্যাগ ফেলে। এতে এখন সুরক্ষিত আছে হাসপাতাল। তবে গত বছরও কেদারপুরে ভাঙনে বেশকিছু বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে গেছে। ওই উপজেলা সদরই নদীগর্ভে চলে যাওয়ার শঙ্কা আছে।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যুগান্তর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, দেশের উত্তর, উত্তর–পূর্ব, পূর্ব এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলে বন্যার বাড়তি পানি বন্যার শুরু থেকেই চাঁদপুর হয়ে নামছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। চাঁদপুরের পরে মেঘনার অসংখ্য শাখা নদী আছে। ওইসব নদী দিয়ে পানি নামার কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
বরিশালের সন্ধ্যা, সুগন্ধা আর আড়িয়াল খাঁ নদীর কারণে বাবুগঞ্জ উপজেলায় ব্যাপক ভাঙন চলছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে হিজলা–মুলাদী এলাকা। পায়রা, লোহালিয়া, তেঁতুলিয়া নদীর কারণেও পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকা ভাঙছে। বিশেষ করে লোহালিয়া নদীর কারণে দুমকি উপজেলার চর গরবদীতে ভয়াবহ ভাঙন চলছে। বগুড়ায় বাঙালি ও করতোয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাস, টাঙ্গাইলে ধলেশ্বরী, নওগাঁয় আত্রাই, গোপালগঞ্জে মধুমতিসহ অন্যান্য নদী হয়েও পানি নামার সঙ্গে পাড় ভাঙনের খবর পাওয়া গেছে।
সিইজিআইএস অবশ্য গঙ্গা–পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র–যমুনা অববাহিকা নিয়ে পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। সংস্থাটি বলছে, আগামী বছরের মধ্যে দেশের ২ হাজার ৩৮৫ হেক্টর বা প্রায় ২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এতে ১২ জেলার প্রায় ২৪ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারাতে পারে।
সিইজিআইএসের বিশেষজ্ঞ সুদীপ্ত কুমার হোড় যুগান্তরকে বলেন, স্যাটেলাইটে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর গবেষণা করে আমরা নদীভাঙন ঝুঁকির স্থান চিহ্নিত করে থাকি, যাতে ভাঙনের তীব্রতা ও সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা যায়। ২০০৭ সাল থেকে সংস্থাটি এই কাজ করে আসছে। পূর্বাভাসের প্রায় ৮০ শতাংশই প্রতি বছর মিলে যাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত নদীভাঙন শুরু হয় বন্যার পর। কিন্তু এক মাস ধরে বন্যা চলার পাশাপাশি পানিও নেমে যাচ্ছে। যে কারণে ভাঙনও শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, বন্যায় পানির নিচে চলে যায় নদীর দু’কূল। এতে মাটি নরম হয়। এরপর যখন পানি ব্যাপকভাবে নামতে শুরু করে তখনই তীব্র ভাঙন শুরু হয়। সুরক্ষামূলক পদক্ষেপে ভাঙন রোধ সম্ভব।