ধেয়ে আসছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল– এ খবরে বাগেরহাটের মোংলা বন্দরে জারি হয় ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত। বন্ধ হয়ে যায় সব কোলাহল। ফুঁসে ওঠে পশুর নদ। গতকাল বুধবার দুপুরে মোংলার সেই নদের বুক থেকে কানে বাজে মোটরচালিত নৌকার ধ্বনি। ছোট–বড় এসব নৌকায় চেপেই কাজে যোগ দিচ্ছেন হাজারো শ্রমিক। জলবায়ু সংকটে বিপর্যস্ত বাংলাদেশে মোংলার ইপিজেড ছোট্ট এ বন্দরনগরীকে বিপদগ্রস্ত মানুষের কর্মসংস্থানের কেন্দ্র করে তুলেছে।
মহিবুর রহমানের সঙ্গে নৌকাঘাটে কথা। ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সব হারিয়ে তিনি থিতু হন মোংলায়। নৌকা চালিয়েই এখন তাঁর সংসার সচল। আম্পানের সময় স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে খুলনার কয়রার কপোতাক্ষপাড়ের কাটমারচর গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। মধ্যরাতে হঠাৎ পানির শব্দে ঘরের বাইরে এসে টর্চলাইটের আলোয় দেখেন বিকট শব্দে নদের বাঁধ ভেঙে পানির স্রোত আসছে বাড়ির দিকে। পড়িমরি করে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বাড়ির কাছে একটি একতলা স্কুল ভবনে গিয়ে আশ্রয় নেন। অল্প সময়ে সেই ভবনের নিচতলা পানিতে ডুবে যায়।
ততক্ষণে নদে বিলীন হয়ে যায় মহিবুর রহমানের সাজানো বাড়িঘর। পরে পেটের দায়ে মোংলার ডোবা বস্তিতে নেন আশ্রয়। সেই থেকেই চলছে যুদ্ধ। দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকাই যেন তাঁর নিয়তি। এবার ঘূর্ণিঝড় রিমালেও পুরোনো সেই স্মৃতি মনে করে তিনি ছুটে গেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। পরে ঘরে এসে দেখেন পানিতে একাকার। এভাবে একেকটা ঝড়ের মৌসুম আসে, আর মোংলার মানুষ নতুন করে টিকে থাকার প্রস্তুতি নেয়। সামান্য ঝড়ে যেন ঘরটা পড়ে না যায়, কিংবা চালাটা উড়ে না যায়, সেজন্য চলে নানা আয়োজন।
মহিবুর রহমানের সঙ্গে কথা শেষ করে মোংলা শহর থেকে সুন্দরবনের কোলঘেঁষা চিলা ইউনিয়নের কেয়াবুনিয়া গ্রামে যেতে পথে পথে ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষত চোখে পড়ে। পিচঢালা পথে অটোরিকশায় দুই ঘণ্টার এই পথচলায় চারদিকে শুধুই পানি। মাছের ঘের ভেসে গেছে। বাড়ির উঠানে এখনও পানি। চিলা ইউনিয়নের কিয়াবুনিয়া গ্রামে পশুর নদের পাড়ে কয়েকশ পরিবারের বসত। নদের এই পাড় থেকে সুন্দরবনের সবুজ অরণ্য দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। নদে উত্তাল স্রোত, বইছে শো শো বাতাস। এখানে বাস করা মানুষের পরিবারে তিন দিন ধরে চুলা জ্বলেনি। অনেকের ঘরে খাবার নেই। আবার কারও জাল–নৌকা জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। প্রায় পরিবারেরই হাঁস–মুরগি মারা গেছে। কিয়াবুনিয়া গ্রামের মানুষের বেশির ভাগই জেলে। আবার কেউ কেউ দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কেউ জীবন চালাতে হাঁস–মুরগি, গরু–ছাগল পালন করেন। গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রিমাল তাদের আয়ের সব পথ একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গেছে।
শুধু কিয়াবুনিয়া গ্রাম নয়, মোংলার সোনাইতলা, জয়মণি, চিলা, সুন্দরবন ইউনিয়ন ও চাঁদপাই ইউনিয়নেও অভিন্ন দৃশ্য।
সোনাইতলা ইউনিয়নের জয়খাঁ গ্রামের জয়শ্রী দাশ বলেন, ‘ঝড়ের সময় আমরা ব্র্যাকের জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। এখানে নারীদের জন্য ছিল সুন্দর ব্যবস্থা। এখন আমরা খাবার পানি নিয়ে সবচেয়ে বিপদে আছি। আমরা বিশুদ্ধ খাবার পানি চাই।’ কিয়াবুনিয়া গ্রামের আফজাল হোসেনের পশুর নদের পাড়ে ছোট্ট ঘর।
ঘরে গিয়ে দেখা গেল সব পানিতে ভিজে একাকার। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তিনি বলেন, ‘ঝড়ের খবর হুইন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়া উঠছি। আর কোনো দিকে খেয়াল করতে পারি নাই। জোয়ারের পানিতে আমার ঘরের মালপত্র ভাইস্যা গ্যাছে।’
ঝড়ের পর গ্রামের বাসিন্দাদের অনেকেই সর্দি–কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এর মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। আজহার আলী নামে একজন জানান, তাঁর চার বছরের শিশু সৌরভ ও পাঁচ মাস বয়সের শিশু আয়ান দু’দিন ধরে জ্বরে ভুগছে। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় জোয়ারের পানিতে ভিজে তাঁর দুই শিশুপুত্রের ঠান্ডা লেগেছে। এ রকম আরও অনেক শিশু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে।
কিয়াবুনিয়া গ্রামে নদের পাড়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ এক নারীকে দেখা গেল খেয়া জাল নিয়ে ভাসছেন। মাছের আশায় উত্তাল স্রোত উপেক্ষা করে ছুটছেন তিনি। পাড়ে উঠতেই রেশমা বেগম তাঁর বিধ্বস্ত ঘর দেখাতে নিয়ে গেলেন। ঘরে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর দুই মেয়ের বিমর্ষ চেহারা। মেয়ে দুটিকে দেখিয়ে রেশমা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলেন, ‘আমার স্বামী আমাদের ছেড়ে বছর দুয়েক আগে চলে গেছেন। তার পর থেকে দুই মেয়েকে নিয়ে যুদ্ধ করছি। তিন দিন ধরে ঘরে চুলা জ্বলছে না। গ্রামে এক মেম্বার আজ দুপুরে কিছু খিচুড়ি দিয়েছে, রাতে কী খাব জানি না।’
তিনি বলেন, ‘৪০ বছরের এই জীবনে ইয়াস, আম্পান ও আইলার মতো দুর্যোগ এই নদের পাশে থেকেই দেখেছি। কিন্তু এবারের মতো ঘূর্ণিঝড় জীবনে দেখিনি।’
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তখনও পেটে দানাপানি পড়েনি গৃহবধূ ফাতেমা বেগমের। কীভাবেইবা পড়বে? রিমালের তাণ্ডব আর টানা বৃষ্টি তাদের জীবনকে এলোমেলো করেছে। তিন দিনে না পেয়েছেন খেতে, না হয়েছে ঘুম।
মঙ্গলবার দুপুরে ঘরে জমে থাকা হাঁটুপানি নামলেও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে সব জিনিসপত্র। কাদাপানিতে ঘরের মেঝে একাকার। ফাতেমা ঘরের তছনছ অবস্থা গুছিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন। এক ছেলে ও নাতিকে নিয়ে তাঁর সংসার। ছেলের বউ মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের রাতে বিভীষিকাময় স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ঝড়ের সময় হঠাৎ ঘরে সাপ ঢুকে যায়। আতঙ্কে নাতিকে কোলে তুলে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছি। সকালে ফিরে দেখি ঘরের সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। নাতিটা গতকাল ধরে একটু খাবারের জন্য কান্না করছে। দোকান থেকে বাকিতে বিস্কুট এনে মুখে দিয়েছে। বারবার বলছে ভাত খাব, বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ঘরে কিছুই নেই। তিন দিনেও কেউ দেখতে আসেনি।
পশুর নদের পাড়ের বাসিন্দারা যখন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন, তখন সূর্য হেলে পড়েছে। আকাশে তখন মেঘের ঘনঘটা। সন্ধ্যা পড়ি পড়ি। তবু কথা শেষ হয় না দুর্গত মানুষের। যেন দুঃখের কথা বলে চাপা কষ্ট দূর করার চেষ্টা। কত কথা তাদের মনে জমা। শেষ বিকেলে ফেরার পথে আব্দুল ওহাব নামে গ্রামের এক বাসিন্দা হাত ধরে কথা বলতে চাইলেন। তিনি খুলনা কয়রায় দু’বার নদীভাঙনে সব হারিয়েছেন। ঘূর্ণিঝড় আইলায় সব হারিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মলিন চোখে তাকিয়ে তাঁর প্রশ্ন– ‘আমাগো এই দুর্দশা কবে শ্যাষ হইবো, কইতে পারেন?’
মোংলার স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেন, সরকার সহায়তা দিচ্ছে শহরের আশপাশে। কিন্তু দুর্গম এলাকার দিকে নজর নেই। সুন্দরবনের আশপাশের দুর্গম এলাকার মানুষকে বাঁচাতে এখনই জরুরি ভিত্তিতে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা দরকার।
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মুহিববুর রহমান বলেন, মাঠ পর্যায়ে তালিকা তৈরির কাজ চলছে। দুর্গম এলাকাগুলোতে এখন রাস্তাঘাট ঠিক হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যে সব এলাকায় সহায়তা পৌঁছে যাবে। আমরা যখন যেখানে দুর্গত মানুষের খবর পাচ্ছি, সেখানে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি।
এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো–অর্ডিনেশন সেন্টারের দুর্যোগসংক্রান্ত দৈনিক প্রতিবেদনে গতকাল বুধবার বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে দেশের সাত জেলায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া উপকূলীয় ও এর আশপাশের ১৯ জেলায় প্রায় পৌনে ২ লাখ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ৪০ হাজার ৩৩৮টি এবং আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫২৮টি ঘরবাড়ি।
দুর্যোগ–সংক্রান্ত দৈনিক প্রতিবেদনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে খুলনা জেলায়। এ জেলায় ২০ হাজার ৭৬২টি ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। বাগেরহাটে বিধ্বস্ত হয়েছে ১০ হাজার ঘরবাড়ি। বাকিগুলো বিভিন্ন জেলায়। ওই প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এ ঝড়ে দুর্গত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৬ লাখ।