পায়রা সমুদ্রবন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের গভীরতা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। এক মাসে বন্দর চ্যানেলের গভীরতা ২ দশমিক ৩ মিটার হ্রাস পেয়েছে। এতে বড় জাহাজ (মাদার ভ্যাসেল) জেটিতে ভিড়তে না পারায় মাল খালাস করতে হচ্ছে ছোট জাহাজে। বাড়ছে আমদানিকারকদের ব্যয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গভীরতা এভাবে কমতে থাকলে অদূরভবিষ্যতে এই সমুদ্রবন্দরে জাহাজ আসা কমে যাবে। এতে বন্দরের আয় কমবে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। ঠিকমতো জাহাজ না এলে জ্বালানির সংকট দেখা দেবে। আর ছোট জাহাজে কয়লা আনলে খরচ বাড়বে। যদিও এই চ্যানেল খননে (ড্রেজিং) এরই মধ্যে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। জানা গেছে, চ্যানেল ড্রেজিং করে গভীরতা রক্ষার দায়িত্বে থাকা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় গভীরতা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। গত এপ্রিল পর্যন্ত ড্রেজিংয়ের কাজ করে বেলজিয়ামভিত্তিক কোম্পানি জান ডি লু। প্রায় ২২৫ মিটার দীর্ঘ ও ৩০ মিটার প্রস্থের এবং সাড়ে ১০ মিটার গভীরতার রাবনাবাদ চ্যানেল ক্যাপিটাল ড্রেজিং শেষে ২০২৩ সালের মার্চে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সে সময় বলা হয়, এই চ্যানেলে ৬০ হাজার টনের জাহাজ ভিড়তে পারবে। গত এপ্রিল পর্যন্ত জান ডি লু এই চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, ‘নতুন করে ড্রেজিংয়ের দায়িত্ব দিতে সময় লাগবে। কিন্তু বন্দর বন্ধ হতে দেব না। আমরা পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি, যেভাবেই হোক চ্যানেলের গভীরতা ধরে রাখতে হবে।’ এ বিষয়ে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল আবদুল্লাহ আল মামুনকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও সাড়া মেলেনি।
গেছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা
ভৌগোলিকভাবে পায়রা বন্দরের অবস্থান এমন এক জায়গায়, যেখানে নদীর পানি সমুদ্রে পড়ার আগে প্রচুর পলি ফেলে যায়। এ ছাড়া নিয়মিত জোয়ার–ভাটা ও ঝড়ের কারণে পলি পড়ে। পায়রা বন্দরের পলি নিয়ে ২০১৯ সালে সমীক্ষা চালায় জার্মানি, বেলজিয়াম ও বাংলাদেশের একটি গবেষক দল। তারা জানায়, হিমালয় থেকে বছরে ১১০ কোটি ঘনমিটার পলি বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে। এর মধ্যে পায়রা নদীর ওই চ্যানেলের আশপাশের এলাকায় বছরে ৪০ কোটি ঘনমিটার পলি জমা হয়।
বন্ধের শঙ্কায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র
সমুদ্রবন্দরের কাছে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ–চায়না পাওয়ার কোম্পানির (বিসিপিসিএল) ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কেন্দ্রটি গড়ে গ্রিডের ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। কেন্দ্রটি চালাতে দিনে গড়ে ১৩ হাজার টন কয়লা লাগে। এই কয়লা আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। চ্যানেলের গভীরতার ওপর নির্ভর করে জাহাজে কয়লা তোলা হয়।
প্রতি মাসে গভীরতার চার্ট প্রকাশ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেই অনুসারে বিসিপিসিএল কয়লা আমদানি করে। গত এপ্রিলে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রকাশিত গভীরতা তালিকায় চ্যানেলের গভীরতা ছিল সাড়ে ৯ মিটার, যাতে ৩৮ হাজার টন কয়লা নিয়ে জাহাজ বন্দরে ভিড়তে পারত। মে মাসের প্রথম দিকে প্রকাশিত আরেক তালিকায় গভীরতা দেখানো হয় ৮ দশমিক ৬ মিটার। এ সময় ৩০ হাজার টনের জাহাজ ভেড়ানো যেত। সর্বশেষ গত সপ্তাহে আরেক তালিকায় গভীরতা দেখানো হয় ৭ দশমিক ২ মিটার। এতে জাহাজের লোড আরও কমে হয় ২৪ হাজার টন। এভাবে গভীরতা কমতে থাকায় কয়লা আসছে কম। যেসব জাহাজ বেশি লোডে কয়লা এনেছে, সেগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের গভীরে লাইটারেজে মাল খালাস করছে। এভাবে কয়লা খালাসে খরচ টনে ১৬ ডলার পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এ ছাড়া হঠাৎ করে লোড কমানোয় কয়লা পরিবহনকারীকে জরিমানা দিতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আর কয়লা পরিবহন কম হওয়ায় মজুত কমে উৎপাদন বন্ধ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।