আমি তোমাদের সহভাগিতা ছেড়ে চলে যাবো, বিষয়টি নিয়ে বহুবার ভেবেছি! জবাব একটা কিছু পেয়েছি যা বড়ই আশা ব্যঞ্জক। বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন; কয়েকদিন কেঁদেছি, তারপর সব ঠিক, আগের মতোই চলছে। আমার আত্মজা চলে গেছে, তখনও বহুবার কেঁদেছি, আজ পর্যন্ত উক্ত বিদায়ের ঘন্টা বার বার অন্তরের শ্রবনেন্দ্রিয়ে আনুরণিত হয়ে চলছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাহ্যত যতোই কান্নাকাটা দেখা যায়, এর প্রভাব ভিতরে ততোটা ফেলতে পারছেনা।
বর্ষাকালে কাঁচা পথ–ঘাট অচল হয়ে পড়ে, তবে কিছু কিছু অংশ একদম অচল হতে দেখা যায়, আবার ২/৪ পশলার পর সাবেক হয়ে ওঠে, পথ চলা আগের মতো চলতে থাকে। মানুষের মনটা ব্যক্তি বিশেষে ব্যতিক্রমি হতে দেখা যায়। যেমন কোনো কোনো মানুষ ভ্রাতা খুনা করতে সদা ওঁৎ পেতে থাকে, তাদের বলা হয় পাষাণ হৃদয়; আবার কোনো ব্যক্তি কটুবাক্য উচ্চারণ করার পর বিবেকের দংশনে ব্যাথা পেতে থাকে, সম্ভব হলে ছুটে যায় তার কাছে যাকে গালমন্দ করেছে, আর ক্ষমা চেয়ে নিজে মুক্তি লাভ করে। সে যা হোক, ভূপৃষ্টে বহুচরিত্রের আস্তরণ রয়েছে, চলার পথে আমাদের একটু সাবধান হয়ে চলতে হবে।
মানব যাত্রার প্রারম্ভে অবাধ্যতা ও ভ্রাতৃখুনের মাধ্যমে আমরা হাত পাকিয়েছি। আমাদের জীবন–চরিত্র, ধ্যান–ধারণা, আচার–অনুষ্ঠান পুরোটাই কলুষিত, পদে পদে অবাধ্যতা হিংস্রতার চিহ্ন বহন করে চলছে প্রকাশ্য দিবালোকের মতো। আদি কথা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। কে আমাদের নির্মাতা, কি আছে তাঁর মনে, কি পরিকল্পনা নিয়ে তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, এত সুন্দর বাগান বাগিচা কেনইবা সৃষ্টি করলেন আর কোন গুনা–পনার জন্য তিনি আমাদের স্বসম্মানে ঠাই দিলেন উক্ত বাগান বাড়িতে, সুখে শান্তিতে বসবাসের জন্য, সে খবর জানার কোনো প্রয়োজনই আজ আমরা বোধ করছি না। কথায় বলে নগদ যা কিছু পাও তা দু’হাত বাড়িয়ে লুফে নাও। কে, কোন লগ্নে, কোন উদ্দেশ্যে, কার জন্য এত সব উপাদেয় দ্রব্য নির্মাণ করলেন সে দিকে নজর দিয়ে কি হবে? এদেরই বলা হয় অবোধ জনগোষ্টি।
অবশ্য জগতের চিরাচরিত রেওয়াজে দেখা যায়, যখন একদল আসে তখন তার পূর্বসুরিদের বিদায় নিতে হয়, এটাই হলো পৃথিবী। তাই কারো বিদায়ের কুফল যে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে তা বলা ঠিক হবে না। আবার যারা নিজেদের চিরস্থায়ী বাসিন্দা ভেবে বসে আছে তাদেরও এক বিশেষ মুহুর্তে বিদায় ঘণ্টা বাজাতে হবে তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। তবে আমাদের সাধ্যমত আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, প্রত্যেকের সাথে সৎভাব বজায় রেখে জীবন–যাপন করা।
যে কথা বলছিলাম, আমার সৃষ্টির পিছনে মহান মাবুদের যে পরিকল্পনা রয়েছে তা আমাকে অবশ্যই জানতে হবে, নতুবা ব্যাটে বলে এক না হলে রান হবে কেমন করে। আমি যে এলাকায় বড় হয়েছি সে এলাকাটি হলো নদীমাতৃক এলাকা। আমার দৃষ্টান্তের মধ্যে নদী, জল, নৌকা, মাছ প্রভৃতি উঠে আসে সচরাচর। যে বাড়িতে ছেলে বেলা ছুটাছুটি করেছি, উক্ত বাড়িটিও ছিল আমাদের ভাগি–শরিক–শুণ্য একছত্র আধিপত্য। স্বাভাবিক কারণে আমি নৌকার সাথে ছিলাম অভ্যস্থ। তাই একটি নৌকার দুটো দিক থাকে, দুটো গলুই থাকে। তবে দুজনকেই একমুখো হয়ে একই দিকে চলতে হয়। যেমন স্বামী–স্ত্রী একটি পরিবারের দুজন পরিচালক, তাই সংসার স্বরূপ নৌকাটিকে চলমান রাখতে হলে উভয়কেই একাগ্রচিত্তে চলতে হবে, অন্যথায় যাত্রা পথে নেমে আসবে চরম বিপর্যয়। যেমন সুঁচ দিয়ে কাপড় শেলাই করা হয়, তবে উক্ত সূচের অগ্রভাগ যদি ছিড়ে দুভাগ হয়ে যায় তবে তা আর সেলাইয়ের কাজে লাগালো সম্ভব থাকে না, তাতে কি উক্ত মাথাচেরা সূচ দিয়ে অবাধে খোচানো চলে।
বাদ–বিভেদ করে সময় নষ্ট করার সময় বার্ধ্যক্যের কোঠায় এসে আর থাকে কি করে! আমি জানতে পেরেছি আমার আহবান। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছে, এতদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন, যতœ-আদরে ধরে রেখেছেন, আমার প্রতি তাঁর সমাদরের বয়ানটুকুই যথেষ্ট হবে পথ হারা, দিকহারা অপাংক্তেয় ব্যক্তিদের পিতৃগৃহে ফিরিয়ে আনার সহায়ক অনুপ্রেরণা হিসেবে। মাটির পৃথিবী প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে মাটি করে ছাড়ে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমিও এক পর্যায়ে মাটির সাথে মিশে গিয়েছিলাম। একসময় আমি নিজেকে মৃত্যুর হাতে তুলে দিয়েছিলাম, কিন্তু তখনও সময় পূর্ণতা পেল না, তাই আমাকে মাটির পৃথিবীতে থাকতে হলো, আর তা অদ্যাবধি। তারপর বুঝতে আর কোনো কষ্ট হলো না, আমাকে দিয়ে মহান নির্মাতা কি করাতে চান। আজ আমি স্থীরভাবে বুঝতে পেরেছি, তার প্রেম ক্ষমার বিষয়ে জ্ঞাপন করাই হলো আমার একমাত্র দায়িত্ব। আমি তো বরাবরের মতো জমিদার, আমার প্রতি রয়েছে তাঁর অপার অভাবিত অনুগ্রহ যা পৃথিবীর কোনো নিক্তিতে তুল্য করা সম্ভব নয়। চলার পথে লোভাতুরা মনটা আমাকে বহুবার কষ্ট দিয়েছে; যতবারই আমি বিপন্ন হয়ে পড়েছি, ততবারই তিনি তরিৎগতিতে ছুটে এসেছেন আমাকে সুরক্ষা করার জন্য, আমি আশ্চর্য হয়েছি, অপব্যায়ি অবাধ্য সন্তানের জন্য পিতার সীমাহিন প্রেমযত্ন দেখে। যিনি আমার মতো অবাধ্য দুষ্ট সন্তানের প্রতি এতটা যতœবান তিনি অবশ্যই আর দশজনের উপর আরো অধিক যতœবান রয়েছেন, তা আমি হলফ করে বলতে পারি।
অবশ্য পাক–কালামে আমাকে নির্দেশনা দিয়েছেন সমুদয় রাজ্যে সকল জনগোষ্টিকে মাবুদের প্রেম ক্ষমার কথা ঘোষণা দেবার জন্য। এটি কোনো অনুরোধ নয় বরং আজ্ঞা, ফরজে–আইন, আর এ কাজের মাধ্যমেই মাবুদের বাধ্যতার প্রমাণ দিতে হবে।
মাবুদের প্রতি প্রকৃত প্রেম প্রত্যেককে সঞ্চালিত করে থাকে। প্রকৃত প্রেম নিরব থাকতে পারে না। ঐশি প্রেম প্রকাশের জন্য মসিহ নিজের প্রাণ পর্যন্ত মর্মবিদারক সলিবে কোরবান করলেন বিশ্বের তাবৎ গুনাহগারদের অবমুক্ত করার জন্য।