গাজীপুরের বাসিন্দা সুকুমার চন্দ্র বিশ্বাস (৩৩) স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে ২০২২ সালে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতে গিয়েছিলেন। কিন্তু দক্ষতা না থাকায় এক বছরের বেশি টিকতে পারেননি। বর্তমানে ঢাকায় গাজীপুরের কালীগঞ্জ স্বাস্থ্যপ্লেক্সে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
তিনি বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানি সিটি গ্রুপের মাধ্যমে দুই ধাপে ৬০০ স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ ছাড়া কুয়েতে পাঠানো হয়। ভাষাগত সমস্যা ও পারিবারিক জটিলতার কারণে ফিরেছি।
সুকুমারের মতো হাজার হাজার স্বাস্থ্যকর্মী প্রতিবছর বিদেশে গেলেও দক্ষতার অভাবে বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়ে দেশে ফিরে আসতে হয় অনেককে। আবার অনেক দেশে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিতে আগ্রহের কথা জানালেও দক্ষ নার্স সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি দক্ষ জনবল সংকটে ধুঁকছে দেশের নার্সিং খাত।
এমন পরিস্থিতিতে আজ রোববার পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক নার্স দিবস’। দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আমাদের নার্স আমাদের ভবিষ্যৎ, অর্থনৈতিক শক্তি নার্সিংসেবার ভিত্তি’। এ উপলক্ষে সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সদের সংগঠনগুলো নানা সেবামূলক কর্মসূচি পালন করবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল ও ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেসের (বোয়েসেল) তথ্য বলছে, গত এক বছরে কুয়েত ও সৌদি আরবে প্রায় ১ হাজার নার্স পাঠানো হয়। তবে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা, পেশাগত পরিবেশ এবং ভাষাগত দুর্বলতার কারণে ২০০ জনকে দেশে ফিরতে হয়েছে। এ ছাড়া জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ হাজারের মতো দক্ষ নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। দক্ষতার অভাবে নার্সরা আবেদন করতে পারছেন না। সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া ২ হাজার নার্স নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে প্রার্থীকে ইংরেজি ভাষাগত দক্ষতার কোর্স ‘আইইএলটিএস’ থাকা লাগবে। এমন দক্ষ নার্স মিলছে না। এই সংকট নিরসনে কানাডা ও যুক্তরাজ্য ঢাকায় নার্সিং প্রশিক্ষণ একাডেমি তৈরিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠকও হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, চিকিৎসক ও নার্সের অনুপাত হতে হবে ১: ৩। অর্থাৎ একজন চিকিৎসকের সঙ্গে অন্তত ৩ জন নার্স থাকতে হবে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) নিবন্ধিত দেশে চিকিৎসক রয়েছেন ১ লাখ ২৩ হাজার ৮৭৩। সেই অনুযায়ী দেশে নার্স প্রয়োজন ৩ লাখ ৭১ হাজার ৫৫৯।
তবে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে সরকারি–বেসরকারি কর্মরত নার্স ৯৫ হাজার ১৬৮ জন, যা চাহিদার তুলনায় বেশ কম। বর্তমানে দেশে ৬৭টি সরকারি ও ৩৭২টি বেসরকারি নার্সিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিবছর ৩৫ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। পড়ালেখা শেষ করে প্রতিবছর বের হয় ২৫ হাজারের মতো নার্স।
বাংলাদেশ প্রাইভেট নার্সিং কলেজ অ্যান্ড অ্যালাইড হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার ইনস্টিটিউট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু হাসনাত মো. ইয়াহিয়া বলেন, দেশে দক্ষ নার্সিং জনবলের ব্যাপক ঘাটতি। এই পেশায় যুক্ত হতে আগ্রহীদের সংখ্যা কম। তা ছাড়া নার্সিং শিক্ষা, সেবা প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মতো বিনিয়োগকারীও কম।
বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি গোলাম মোর্শেদ বলেন, দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে নার্স পাঠানো যায় না। দেশের নার্সিং শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিদেশের নার্সিং শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। মানহীন নার্সিং প্রতিষ্ঠান এখন ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে, এটাও সংকটের কারণ।
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) নাসির উদ্দিন বলেন, নার্সিং কলেজগুলোতে শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করছি। দক্ষ নার্সের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। তাই তাদের ওপর কাজের চাপ বেশি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর দক্ষতা বাড়তে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দক্ষ নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী তৈরির লক্ষ্যে কানাডা বাংলাদেশে একটি নার্স প্রশিক্ষণ একাডেমি তৈরি করবে। এর মাধ্যমে কিছুটা হলেও দক্ষ নার্সের সংকট কমবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।