সিনেমার পর্দায় সাধারণ মেয়ে হিসেবে তাকে যেভাবে দেখা যেত, বাস্তবের গ্রামীণ নারী বা শহুরে মধ্যবিত্তের ঘরের মেয়ের চরিত্রটা ঠিক সেরকম ছিল। অভিনয়শিল্পী হিসেবে নিজস্ব স্বকীয়তা ও সহজাত প্রবৃত্তি তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা অবস্থান দিয়েছিল। তাকে বলা হতো চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’; কিন্তু তার মধ্যে যে গুণটা বেশি দেখা গেছে তা হচ্ছে– দর্শক তাকে দেখলেই মনে করত এটা তো আমাদের ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’। কারণ তার চেহারায়, আচরণে, অভিনয়ে সেই বিষয়টা ছিল। খুব বেশি মেকআপ করতেন না, এমনকি চুলটাও একদম সাধারণ একটা মেয়ের মতো রাখতেন। যার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে খুব আপন হয়ে ধরা দিতেন। বলা হচ্ছে সারাহ বেগম কবরীর কথা। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২১ সালের এই দিনে মারা গেছেন তিনি। মহামারী করোনায় যে কজন কিংবদন্তি তারকা বিদায় নিয়েছেন, কবরী তাদের অন্যতম।
সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের গ্রাম–গঞ্জের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তরাও কবরীকে যতটা নিজেদের মানুষ হিসেবে ভাবতে পেরেছিলেন, ততটা হয়তো বাংলাদেশের সিনেমা জগতে অন্য কোনো অভিনেত্রীর ক্ষেত্রে পারেননি। আর সেজন্যই ‘মিষ্টি মেয়ে’ নামে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৫০ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামে জন্ম হয় কবরীর। তার আসল নাম ছিল মিনা পাল। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবির মধ্য দিয়ে সিনেমায় অভিষেক, সে সময়ই নতুন নাম হয় কবরী। এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলেছিলেন, ‘সুতরাং’ সিনেমার কিশোরী কবরী দর্শকদের কাছে যে এতটা জনপ্রিয়তা পাবে, সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি। শুরুর দিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে তাকে প্রচুর রিহার্সাল করতে হয়েছিল। ভাষা থেকে চাঁটগাইয়া আঞ্চলিক টান এবং কথায় নাকি নাকি ভাব দূর করতে! কবরী বলেছিলেন, ‘চোখ তুলে তাকাতে সাহস পেতাম না, খুব লজ্জা পেতাম। সব দত্তদা (সুভাষ দত্ত) শিখিয়েছেন; কিন্তু ‘সুতরাং’-এর পর আমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।’ এর পরের দুই দশকে ‘রংবাজ’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘দ্বীপ নেভে নাই’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘সুজন সখী’, ‘সারেং বৌ’-এর মতো বহু ব্যবসাসফল এবং আলোচিত সিনেমায় প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী শফিউদ্দিন সারওয়ারকে বিয়ের পর তিনি কবরী সারওয়ার নামে পরিচিতি পান। ২০০৮ সালে তাদের বিয়েবিচ্ছেদ হয়। এর পর যখন রাজনীতিতে আসেন এবং সংসদ সদস্য হন, তখন থেকে তিনি সারাহ বেগম কবরী নামে পরিচিত।
কবরী ছিলেন পাঁচ সন্তানের মা। মীনা পাল বা কবরীর প্রথম স্কুল ছিল আলকরণ। থাকতেন চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারে। আলকরণ স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন তিনি। এর পর কবরীর মা তাকে জেএম সেন হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। কবরীদের পুরো পরিবারটিই ছিল ভীষণ সংস্কৃতিমনা। বড় বোনদের মধ্যে দুই বোন নাচতেন। ছোট ভাই তবলা বাজাতেন। কবরী নাচ–গান একসঙ্গে করতেন। ৭০ বছরের জীবনে তিনি ৫৬ বছর কাটিয়ে দেন চলচ্চিত্রে। সিনেমা নির্মাণেও নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন কবরী। শুরুটা করেছিলেন ‘আয়না’ দিয়ে। সর্বশেষ ‘এই তুমি সেই তুমি’ নামে একটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন। তবে এর কাজ শেষ হওয়ার আগেই মারা যান তিনি। ফলে ছবিটি আর পূর্ণতা পায়নি। রাজনীতিতেও সরব ছিলেন কবরী। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। যুক্ত ছিলেন অসংখ্য নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে। ২০১৭ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’ প্রকাশ পায়। ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বৌ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন কবরী। এর পর ২০১৩ সালে একই পুরস্কার আয়োজনে আজীবন সম্মাননা পান তিনি।
বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী অনেকের প্রিয় কবরী। তার দক্ষ অভিনয় ও মিষ্টি হাসি যেমন সবাইকে মুগ্ধ করত। তেমনি দেশ–বিদেশের অনেকেও তার প্রিয় তালিকায় ছিল। অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে সোফিয়া লরেন, এলিজাবেথ টেলর, অড্রে হেপবার্ন, গ্রেগরি পেক, উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায় ও ছবি বিশ্বাস ছিলেন প্রিয়দের তালিকার সবার আগে। গান শুনতেও খুব পছন্দ করতেন কবরী। এর মধ্যে পপ ধারার গানই বেশি শুনতেন বলে একাধিকবার জানিয়েছিলেন। তবে তার সবচেয়ে প্রিয় সংগীতশিল্পীর তালিকায় দেশের বাইরে মান্না দে, হেমন্ত ও শ্রীকান্ত আচার্য। দেশের মধ্যে সুবীর নন্দী ও সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠ তার খুব প্রিয়। তার সমসাময়িক এমন কেউ নেই, যার সঙ্গে চলচ্চিত্রে তিনি পর্দা ভাগাভাগি করেননি; কিন্তু মনে মনে একজনের সঙ্গে অভিনয়ের স্বপ্নটা দেখতেন, যা কখনই পূরণ হয়নি, এমনকি সেই সুযোগও তৈরি হয়নি। কবরী বলেছিলেন, ‘অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করার খুব আগ্রহ ছিল। তার অভিনয় ও কথাবার্তা মুগ্ধ করত। অমিতাভকে স্বপ্নেও দেখেছি বহুবার।’