বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে এবং শিল্পের ক্যাপটিভ পাওয়ারে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে ৭৫ পয়সা করে বাড়িয়েছে সরকার। এতে করে বিদ্যুতের দাম বাড়বে, বাড়বে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ব্যয়। এ দামবৃদ্ধির সার্বিক প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনেও। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে এমনিতেই চাপে আছে মানুষ। দামবৃদ্ধির এ সিদ্ধান্তে সেই চাপ আরও বেড়ে যাবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। উপরন্তু গ্রাহকপর্যায়ে যে কোনো সময় বাড়তে যাচ্ছে বিদ্যুতের দামও। দামবৃদ্ধির এ বোঝাও আমজনতার ঘাড়ে এসে পড়বে।
বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির ঠিক আগমুহূর্তে বাড়ানো হলো গ্যাসের দাম। গতকাল মঙ্গলবার সরকারের নির্বাহী আদেশে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে নতুন দাম ঘোষণা করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে বিদ্যুতের দামও বাড়বে। সরকারি–বেসরকারি সব ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১৪ টাকার পরিবর্তে নতুন করে নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ টাকা ৭৫ পয়সা (৫ শতাংশ)। এ ছাড়া শিল্প খাতে নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ক্যাপটিভ) জন্য ইউনিটপ্রতি গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা করা হয়েছে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ৭৫ পয়সা করে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির ফলে প্রতিমাসে গড়ে ৮৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত আসবে পেট্রোবাংলার। বছরে আয় বাড়বে ১০৩২ কোট টাকা। গ্যাসের নতুন দাম ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। তবে আবাসিক, সিএনজি, সাধারণ শিল্প, চাসহ অন্যান্য খাতে দাম বাড়েনি।
এর আগে, গত বছরের ১৮ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশ জারি করে গ্যাসের দাম গড়ে ৮২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। ওই সময় সর্বোচ্চ ১৭৯ শতাংশ বাড়ানো হয় বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম। একই সময়ে শিল্পেও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে তিনগুণ করা হয়, যা গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। গত বছর ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে বিদ্যুৎ খাতের গ্যাসের দাম ১৪ টাকা করা হয়েছিল। আর ক্যাপটিভে ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছিল।
গ্যাসের দাম বাড়িয়ে গত বছরের ১৮ জানুয়ারি জারি করা প্রজ্ঞাপনের সংশোধন হিসেবে গতকাল এটি জারি করা হয়েছে বলে জানানো হয় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে। জ্বালানি বিভাগেরউপসচিব শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপন গণমাধ্যমে পাঠানো হবে।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের অপেক্ষায় আছে। ভেটিং শেষে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ডলারের দামের তারতম্যের কারণে জ্বালানিপণ্য আমদানিতে অনেক লোকসান দিতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামে সমন্বয় করা হবে। তিনি বলেন, গ্রাহকপর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৩৪ থেকে ৭০ পয়সা বাড়তে পারে। মার্চ থেকেই সেই দাম কার্যকর করা হবে। তিনি বলেন, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয়। ঘাটতি মেটাতে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। আগামী তিন বছর ধাপে ধাপে দাম সমন্বয় করা হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখনো প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে ৫ টাকা করে লোকসান গুনতে হচ্ছে সরকারকে। আমরা ক্রমান্বয়ে তা সমন্বয় করব। তিনি বলেন, খরচের চেয়ে বেশি দাম নিলে মূল্যবৃদ্ধি বলা যেত। এখন ঘাটতি অনেক, তাই দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। তবে তা খুবই কম পরিমাণে।
নসরুল হামিদ বলেন, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার আমদানি করতে মার্কিন ডলারের দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা ধরে হিসাব করা হয়েছিল। এখন ডলারের দাম ৪০ টাকা করে বেড়ে গেছে। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে।
তিনি বলেন, জ্বালানি খরচের ওপর ভিত্তি করে সারা বিশ্বেই দাম সমন্বয় করা হয়। সরকার ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কুইক রেন্টাল ও ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন বড় বড় বেইজ লোড বিদ্যুৎকেন্দ্র আসছে। দুই বছরে দুই হাজার মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ আসবে। এখন যে মূল্য সমন্বয় হচ্ছে, সেটি ডলারের দামের কারণে। ভর্তুকি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এই সমন্বয়।
প্রতিমন্ত্রী জানান, জ্বালানি তেলের দামও মার্চের প্রথম সপ্তাহে সমন্বয় করা হবে। সরকার ‘ডায়নামিক প্রাইসে’ যাবে, যেখানে বিশ^বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়লে অথবা কমলে সমন্বয় করা হবে।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, আগে গণশুনানি হতো। একটা জবাবদিহিতা ছিল। আমরা হাইকোর্টে মামলা করে চেয়েছিলাম, বিদ্যুৎ জ্বালানির দামবৃদ্ধি গণশুনানির মধ্যে নিয়ে আসতে। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ার ফলে সেটি বন্ধ।
এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানিপণ্য ন্যায্যমূল্যে আমদানি হচ্ছে কিনা, এর কোনো জবাবদিহিতা নেই। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগকারীদের লুণ্ঠনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন আমরা প্রতিবাদও করতে পারছি না। এমন অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া চলতে চলতে একসময় আমাদের শিল্পকারখানা ব্যবসায় টিকতে পারবে না। দামবৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে সাধারণ গ্রাহকের ওপর জুলুম বলে মনে করেন তিনি। বলেন, বিদ্যুৎ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনমূলক ব্যয় রয়েছে। সেগুলো কমানো হলে দাম বাড়ানোর দরকার হবে না।
এদিকে জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নতুন দাম কার্যকর হলে জ্বালানি খাতে সরকারের ভর্তুকি ৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। জানা যায়, নতুন দামে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি মাসে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে ২৭ কোটি টাকা এবং ক্যাপটিভ থেকে ১৭ কোটি টাকা বেশি পাবে। শুধু তিতাসেরই মাসে আয় হবে ৫২৮ কোটি টাকা। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মোট গ্যাসের ৫৭ শতাংশই ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রে ও ক্যাপটিভে।
এদিকে গ্যাসের দর পুনর্নির্ধারণের ব্যাখ্যা দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন জানান, প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন, আমদানি, সরবরাহ মূল্যের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের পার্থক্যের কারণে সরকারকে এ খাতে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে আর্থিক ক্ষতি–ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৬ হাজার ৫৭০ দশমিক ৫৪ কোটি টাকা। কৃষি সেচ মৌসুম, রমজান মাস ও গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের চাহিদা আরও বেশি থাকে। শিল্প, গৃহস্থালি, সার উৎপাদন, সিএনজি, বাণিজ্যিক ও চা শিল্পে মূল্য সমন্বয় অপরিবর্তিত রয়েছে। এই মূল্য সমন্বয়ের ফলে এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) বর্তমান বাজারমূল্য ও ডলার বিনিময় হার বিবেচনায় বিদ্যমান ভর্তুকি ছয় হাজার কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হবে।
বর্তমানে দেশে ৮ শ্রেণির গ্যাস ব্যবহারকারী রয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩৭ শতাংশ, শিল্পে ২৩, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ১৮, বাসাবাড়িতে ১০, সার উৎপাদনে ৭, সিএনজিতে ৪ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক ও চা শিল্পে ১ শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
সর্বশেষ গত বছরের জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে ৫ টাকা ৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা এবং ক্যাপটিভ ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছিল। তখন শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। তবে পরিবহন খাতে ব্যবহৃত সিএনজি ও আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ায়নি সরকার।
উল্লেখ্য, দেশ এখন ২৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসভিত্তিক। তবে গ্যাস–সংকটে প্রায় অর্ধেক কেন্দ্রেই উৎপাদন বন্ধ থাকছে। এদিকে গ্রীষ্মে উৎপাদন করা হয় ১৩ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। শীতে সেটি ৮ থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসে। দেশে এ পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে গত বছরের ১৯ এপ্রিল, ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট।
পদক্ষেপের অভাবে মূল্যবৃদ্ধি, দায় চাপানো হচ্ছে ভোক্তার ওপর : ক্যাব সভাপতি যথাসময়ে যথোপযুক্ত পদক্ষেপের অভাবে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ছে । আর এর দায়ভার এখন ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনটিই মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভোক্তাদের; বিশেষ করে সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষের কষ্ট অবশ্যই বাড়বে। কারণ ঘুরেফিরে এর চাপ এসে ভোক্তার ওপরেই পড়বে।
তিনি আরও বলেন, সরকার মনে হয় নিরুপায়, তাই দাম বাড়াচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতে সরকার অনেক ভালো কাজ করেছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণে ব্যর্থ হওয়া, ওভার ক্যাপাসিটি সৃষ্টি করে এখন অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া, যে সময়ে ভাড়া করা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা দরকার ছিল, তা না করাসহ অনেক কারণে এখন দাম বাড়াতে হচ্ছে।
সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে অনীহা ছিল বলে মনে করেন তিনি।
লাগাতারভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি করা হলে তৈরি পোশাকশিল্প ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম। গতকাল আমাদের সময়ের সঙ্গে ফোনালাপে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, পুরো বিশে^ অর্থনৈতিক সংকট চলছে। বিদেশি ক্রেতারা ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছেন। মানুষ এখন সব কিছুতে সংকোচননীতি অবলম্বন করছে। পোশাক পরাও কমিয়ে দিয়েছে। যিনি বছরে ৫টি পোশাক কিনতেন, তিনি এখন ৩টি পোশাক কিনছেন। দিন দিন পোশাকের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। শ্রমিকের বেতন বাড়ছে। কিন্তু ক্রেতারা এক পয়সাও দাম বাড়াচ্ছেন না। ফলে উদ্যোক্তাদের চাপ বাড়ছে। গ্যাস–বিদ্যুতের পাশাপাশি ঘাটে ঘাটে খরচ বেড়েছে।
শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, শিল্পমালিকরা কঠিন সময় পার করছেন। শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছেন না। ব্যাংকঋণ করে শ্রমিকদের বেতন দিতে হচ্ছে। নতুন করে গ্যাস–বিদ্যুতের দাম বাড়ায় শিল্পমালিকদের পক্ষে শ্রমিকদের বেতনসহ উৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে যাবে। এর প্রভাব শ্রমিকদের ওপরও পড়বে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা। শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর সহনশীল হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা সহজীকরণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।