“যে লোকেরা অন্ধকারে চলে তারা মহা নূর দেখতে পাবে; যারা ঘনঅন্ধকারের দেশে বাস করে তাদের উপর সেই নূর জ্বলবে” (ইশাইয়া নয় অধ্যায় দুই পদ)।
নবী রাসুলগণ হলেন খোদার মনোনীত সন্তান, যাদের উপর দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছে আলোর মশাল উচু করে ধরে রাখার, যাতে করে তাদের চার তরফের লোকজন আলো দেখতে পারে। শুধু কি দেখতে পায়, অন্ধকারে ডুবন্ত লোকজন আলোর রাজ্যে প্রবেশ করার সুযোগ লাভে ধন্য হয়।
বাস্তবে আলো জ্বালানো হয়ে থাকে অন্ধকার দূর করার জন্য, তেমন ক্ষেত্রে যে একবার আলোর সন্ধান পেয়েছে তাকে তো আর অন্ধকারের রাজ্যে ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়!
নবী ইয়ারমিয়া এক্ষেত্রে চমৎকার একটি ধারণা দিয়েছেন। মাবুদ বলছেন, “তোমরা ভিন্ন জাতিদের আচার ব্যবহার শিখো না, কিংবা আসমানের নানা চিহ্ন দেখে ভেংগে পড়ো না, যদিও ভিন্ন জাতিরাই সেগুলো দেখে ভেংগে পড়ে। এর কারণ সেই লোকদের ধর্মীয় আচার ব্যবহার অসার, তারা বন থেকে একটা গাছ কাটে এবং কারিগর বাটালি দিয়ে তার আকার দেয়। তারা সোনা ও রূপা দিয়ে সেটা সাজায় এবং যাতে সেটা পড়ে না যায় সেজন্য সেটাকে হাতুড়ি ও পেরেক দিয়ে শক্ত করে” (ইয়ারমিয়া দশ অধ্যায় দুই থেকে চার পদ)।
মাবুদ বরাবরের জন্যই অদৃশ্য রূহানি সত্তা। তাঁর ঐশি গুণাবলীও অদৃশ্য। মানুষের মধ্যে গুণাবলী, তাও থাকে অদৃশ্য। যেমন “ছেলেটা বড়ই মেধাবি” একথা প্রকাশ করার সাথে সাথে তার মধ্যে যে মেধা লুকানো রয়েছে তা আপনি দেখাতে পারবেন না, তবে তার কাজকর্ম দিয়ে বুঝে নিতে পারবেন, তার মেধার পরিচয়। ধর্ম বিশ্বাস তো একই, বিশ্বাস কাউকে দেখানো সম্ভব নয়, তবে ব্যক্তির কাজকর্ম, আচার–আচরণ, চাল–চলন দেখে আপনি কেবল আন্দাজ অনুমান করতে পারেন, তার বর্তমান অবস্থান। কথায় বলে, একই হাত কারো গন্ডদেশে সজোরে লাগালে তা অবশ্যই পীড়ন হবে, আবার সেই হাত দিয়ে কাউকে যখন আদর করা হয় তখন হাতের গতি থাকে নিয়ন্ত্রিত, যাকে আদুরে পরশ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ক্রোধ আর আদর কোনোটাই বস্তুবৎ দেখানোর বিষয় নয়।
প্রেম পত্র থাকে প্রেমে ভরা, আসলে তা থাকে অক্ষরের পর অক্ষর দিয়ে সাজানো, বাচনভঙ্গি ও কথার মাধ্যমে বুঝে নেয়া চলে কোনটা প্রেমপত্র আর কোটা গজবে ভরা। ক্রোধ ও প্রেম কেবল মনের বিষয় যা বুঝে নিতে হয়, চোখে দেখা সম্ভব নয়।
বড়দিন বাহ্যিক বস্তুর মধ্য দিয়ে প্রকাশ করার বিষয় নয়। খোদার প্রেম তাও কেউ দেখে নি। মানবরূপে আগত খোদা হলেন প্রেমের প্রকাশ, তিনি নিজের প্রাণ পর্যন্ত কোরবানি দিলেন অসহায় পতিত বিশ্ববাসিকে মুক্তপাপ করার জন্য, তাও হৃদয়ের বিষয়, বাহ্যিক ধনরতœ অর্থবিত্ত ক্ষমতা দাপটের বিষয় নয়।
কলা যখন পেঁকে যায় তখন বাহিরের রং বদলে যায়, সাথে সাথে ভিতরের কষ বিস্বাদ থেকে সুমিষ্ট স্বাদে পরিণত হয়ে যায়। গোয়ার বদমেজাজি কোনো কারণে যদি ভিতরের পরিবর্তন সাধিত হয়, তখন তার পূর্বের আচরণ অবশ্যই পরিবর্তিত হবে; যেমন শৌলের জীবন আচরণে হঠাৎ করে আমূল পরিবর্তন দেখা দিল।
পথিমধ্যে তার সাখ্যাত হয়েছিল খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসিহের সাথে, তিনি তাকে সুশিক্ষা দিলেন; ভ্রান্ত শিক্ষা ও কলুষিত হৃদয়ের পরিবর্তন করে তাকে সঠিক শিক্ষা ও পূতপবিত্র খোদার হৃদয় তার মধ্যে স্থাপন করে দিলেন। চোখের পলকে জঘন্য শত্রæ পরিণত হয়ে গেল পরম বন্ধুতে।
পরিবর্তন কেউ দেখতে পায় না, তবে পরিবর্তিত আচরণ মানুষ বুঝতে পারে। মসিহ এসেছেন মানুষকে গুনাহমুক্ত করার জন্য, হারানো সন্তানদের খুঁজে নেবার জন্য। কাউকে আঘাত করার জন্য নয়, কারো ছিদ্র অন্বেষণ করা তার স্বভাব নয়, ওটা কলুষিত ইবলিসের পেশা।
আমরা নিত্যদিনের হিসেব নিকেশ নিয়ে থাকি ব্যস্ত। গতকল্য আমাদের কাছে অতীত, যা কোনো অবস্থায় আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আর আগামীকল্য অনাগত। আমি আগামীকাল পর্যন্ত যে বেঁচে থাকবো সে নিশ্চয়তা দেব কি করে। আমার জন্য সর্বোত্তম সময় হলো ঠিক এই মুহুর্ত। যে দিন আমি বেঁচে আছি সেদিনের চিন্তা হবে স্বাভাবিক চিন্তা।
মানুষ মানুষের সাথে বিবাদ করে কেবল অতীতকে নিয়ে, বলতে পারেন বাশিপঁচা ক্ষয়িষ্ণু পদার্থ নিয়ে মানুষ মানুষের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে বসে। আর তা হলো ইবলিসের প্রেরণা। মানুষের ক্ষতিসাধন কেবল ইবলিসের প্রতিজ্ঞা। মাবুদ আমাদের অভয়বাণী শুনিয়েছেন, আমরা যেন বর্তমান দিনের বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকি, আগামিকালের জন্য অনাহুত ভাবনা করার কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
ধরুন, আপনি অতীব আগ্রহভরে কোনো কিছু আপনার স্ত্রীর হাতে তুলে দিলেন, তিনি চিলের মতো ছোঁ মেরে দ্রæত হ্যাচকাটানে ওটা নিয়ে নিলেন। বলুন, তার মেজাজ তখন কোন স্তরে চড়ে ছিল? আমরা মানুষ, ক্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে বর্তমানকার বিশ্বে বসবাস করতে বাধ্য। গানের শিল্পী নচিকেতা সম্ভবত ঠিকই বলেছেন, “পুরুষ মানুষ হয় দুই প্রকার, জীবিত আর মৃত”। যতদিন পুরুষ বিবাহ না করে ততদিন সে থাকে জীবিত, আর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার সাথে সাথে সে হয়ে গেল মৃত। অবশ্য গোটা বিশ্ববাসি আজ মৃত, পাপের সাগরে ডুবন্ত। যা নিশ্চয়তা দিয়ে অবশ্যই বলা চলে।
মৃতকে জীবন দান করেছেন খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসিহ। বড়দিন হলো ঈসা মসিহের জন্মদিন। খোদার কালাম ও পাকরূহ মানবরূপে ধরাতলে হলেন আবির্ভূত। তিনি এসেছে মৃতকে জীবন দান করার জন্য। আমরা যারা প্রকৃতার্থে পাপের অধিনে জীবন যাপন করে ফিরছি, তাদের প্রত্যেককে মুক্তপাপ করার জন্য তিনি জগতে মানবরূপ ধারণ করে নেমে আসলেন। লোভে পাপ, আর পাপে মৃত্যু। গুনাহগারদের মৃত্যু অবধারিত। মসিহ আমাদের স্থলে দাঁড়ালেন, বিশ্ববাসির পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বীয় স্কন্ধে বহন করলেন, সলিবে প্রাণ দিলেন, পাপের প্রায়শ্চিত্ত শোধ দিলেন, কেবল বিশ্বাসহেতু বিশ্ববাসি হয়ে গেল মুক্ত স্বাধীন (ইউহোন্না আট অধ্যায় ছত্রিশ পদ)।
পৌলের জীবন আচরণ যেমন হঠাৎ বদলে গেল, যারাই আজ সত্যিকারার্থে মসিহের সাথে যুক্ত হতে পেরেছে, যাদেরকেই মসিহ বেছে নিয়েছেন (ইউহোন্না পনের অধ্যায় ষোল পদ) তাদের জীবনে সত্যিকার পরিবর্তন দৃষ্ট হতে বাধ্য।
কারো জীবনের পরিবর্তন আমরা দেখতে পারি না, তবে সত্যিকারের পরিবর্তনের হাওয়া উপলব্ধি করা সম্ভব। “যদি কেউ মসিহের সংগে যুক্ত হয়ে থাকে তবে সে নতুনভাবে সৃষ্ট হল। তার পুরানো সব কিছু মুছে গিয়ে নতুন হয়ে উঠেছে। এই সব আল্লাহ থেকেই হয়। তিনি মসিহের মধ্য দিয়ে তাঁর নিজের সংগে আমাদের মিলিত করেছেন, আর তাঁর সংগে অন্যদের মিলন করিয়ে দেবার দায়িত্ব আমাদের উপর দিয়েছেন। এর অর্থ হল, আল্লাহ মানুষের গুনাহ না ধরে মসিহের মধ্য দিয়ে নিজের সংগে মানষকে মিলিত করছিলেন, আর সেই মিলনের খবর জানাবার ভার তিনি আমাদের উপর দিয়েছেন। সেজন্যই আমরা মসিহের দূত হিসাবে তাঁর হয়ে কথা বলছি। আসলে আল্লাহ যেন নিজেই আমাদের মধ্য দিয়ে লোকদের কাছে অনুরোধ করছেন। তাই মসিহের হয়ে আমরা এই মিনতি করছি, “তোমরা আল্লাহর সংগে মিলিত হও।” ঈসা মসিহের মধ্যে কোন গুনাহ ছিল না; কিন্তু আল্লাহ আমাদের গুনাহ তাঁর উপর তুলে দিয়ে তাঁকেই গুনাহের জায়গায় দাঁড় করালেন, যেন মসিহের সংগে যুক্ত থাকবার দরুন আল্লাহর পবিত্রতা আমাদের পবিত্রতা হয়” (দ্বিতীয় করিন্থীয় পাঁচ অধ্যায় সতের থেকে একুশ পদ)।